সত্যিই কি ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা?

সত্যিই কি ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা?


হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার গল্প কে না জানে। কিন্তু যদি সত্যিই সেই বাঁশি আালা থাকত আর হ্যা নিয়ে যেত শহরের সব শিশুকে ধরে! আজগুবি কল্পনা বলে অনেকে উড়িয়ে দিলেও জার্মানির হ্যামিলন শহরের বাসিন্দারা কিছু তা-ই বিশ্বাস করতেন। জার্মান শহরের আসল নামটি অবশ্য হ্যামিলেন। তবুও এই গত শতকেও সেই শহরের সকলেই বিশ্বাস করতেন বাঁশিওয়ালার জাদুকরি বাঁশির ক্ষমতায়।

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

বুনজেনস্ট্রেস নামের একটি রাস্তায় কোনো গানবাজনাই চলত না, কারণ প্রায় সকলেরই বিশ্বাস ছিল ওই রাস্তা দিয়েই শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গুহাতে আটকে রাখার জন্য। তাই আবার যাতে সেই পুরোনো ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বাঁশি তো দূরের কথা, যে-কোনো বাজনাই হয়ে গেল নিষিদ্ধ। শহরের পাশে কোপেলবার্গের পর্বতের যে-জায়গায় গুহাতে হারিয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের জন্য শিশুদের দেখা গিয়েছিল, সেখানে নাকি মাটিতে পোঁতা ছিল দু-দুটো কাঠের তৈরি ক্রুশ।

শহরের ইঁদুর তাড়াতে বাঁশিওয়ালার শরণাপন্ন হওয়ার এই গল্পটা অবশ্য বহু পুরোনো। বাঁশিওয়ালার সুরের নেশায় শহরের সমস্ত ইঁদুর দল বেঁধে বেরিয়ে এসে শহরের পাশেই নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শহর ইঁদুরমুক্ত হলে বাঁশিওয়ালাকে প্রতিশ্রুত টাকাপয়সা দিতে রাজি হয় না শহরের মেয়র আর লোকজন । ফলে বাঁশিওয়ালা নেয় সেই নিষ্ঠুর প্রতিশোধ। আবার বাঁশি বাজিয়ে সুরের নেশায় আচ্ছন্ন করে শহরের সমস্ত শিশুকে নিয়ে যায় নদীর তীরে। সেখানেই তারা গুহাতে ঢোকার পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ছোটদের এই মজার রূপকথাটিকে অমর করে যান বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি রবার্ট ব্রাউনিং, তাঁর অসাধারণ কবিতা, 'দ্য পায়েড পাইপার অব হ্যামিলন'-এ।

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

এটাও আশ্চর্যের নয় যে, ছোটদের এই অসাধারণ রূপকথাটিকে ইউরোপের বহু শহর সত্যি মনে করে। শুধু ইউরোপেই বা কেন, মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশেও এই গল্প অনেকে বিশ্বাস করে এবং মনে করে তাদের শহর থেকে অনেক শিশুকে সত্যিই কেউ হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হ্যামিলনের বাসিন্দারা শুধু এই গল্পকে বিশ্বাসই করেন না, তাঁরা সন-তারিখ দিয়ে এই ঘটনাকে সত্যি প্রমাণ করবার জন্য চেষ্টা করেন।

ওয়াবেস নদীর তীরে হ্যামিলন শহরে দুটি ৪০০ বছরের পুরোনো বিশাল প্রাসাদে খোদাই করা আছে ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার দিন। শহরবাসীর হিসেব অনুযায়ী তারিখটা ১২৮৪ সারের ২০ জুন। সমস্ত শহরে ওই গল্পটি মাঝে মাঝেই পড়া হয় স্মরণ ও সতর্কীকরণের জন্য।

শহরের ইতিহাস ঘাটলে সত্যি-সত্যিই এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৪৫০ সালের একটা পুঁথিতে ঘটনাটির বিবরণও আছে। তবে তা শুধুমাত্র শিশুদের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা। তাও সব মিলিয়ে ১৩০ জনের । কিন্তু ১৬ শতকের পর থেকে ওই ঘটনায় বাঁশিবাদককে এবং সেই ইঁদুর তাড়ানো মানুষটির কথা বলা হতে থাকে।

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

১৭ শতকে ঘটনাটা একটু বদলে গেল। নিরুদ্দেশের তারিখটা বদলে হল ২২ জুলাই, ১৩৭৬। কিন্তু এমনভাবে সেই ঘটনাকে সাল-তারিখসহ বলা হতে লাগল যে, সকলেই বিশ্বাস করে নিল। ওই অদ্ভুতুড়ে দুটি বিশাল বাড়ি দেখে বিশ্বাস হওয়া স্বাভাবিক যে, এখানে সত্যিই বাস করত ইঁদুর-ধরিয়ে বাঁশিবাদকটি।

ঐতিহাসিকরা অবশ্য বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখালেন হ্যামিলন শহরের এই উপকথা গড়ে ওঠার সঙ্গে কিছু বাস্তব ঘটনার যোগাযোগ আছে, যার ফলে প্রবাদের মতো কাহিনীটি নগরের লোকের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন ১২১২ ক্রুসেডে হ্যামিলন শহর থেকেও বহু তরুণ যোগদান করে। হয়তো ওই তরুণদের একদল যুদ্ধে যাওয়ার পথেই বিশাল দূরত্ব এবং কষ্ট সহ্য না করতে পেরে মারা যায়। ফলে তারা কোনোদিনই আর হ্যামিলনে ফিরে আসেনি। সম্ভবত এই নবীনদের মৃত্যু ১৩ শতকে শিশুদের নিখোজ হয়ে যাওয়ার গল্পের জোরালো সমর্থনের ভিত্তি ছিল।

অনেকে আবার রটনার পেছনে ১২৬০-এর ঘটনার উল্লেখ করেন। স্থানীয় যুবকদের বড় অংশ এক যুদ্ধে অংশ নিয়ে রণাঙ্গনেই মারা যায়। ফলে শহরের তরুণসম্প্রদায়ের এক বড় অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। স্থানীয় এক বিবাদকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ওই সেডেলমুন্ডের যুদ্ধ গল্পের উৎস বলে অনেকেই মনে করেন। অনেকে অবশ্য ১৪ শতকের ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগে আক্রমণের কথাও বলেন।

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

হ্যামিলন শহরের বহু নাগরিক ভয়ঙ্কর মহামারিতে প্রাণ হারান। ইঁদুররাই ওই ভয়ঙ্কর রোগের জীবাণু বহন করত বলে তারাই প্রথম হাজারে-হাজারে মারা যায়। তাদের থেকে ওই রোগ আসে মানুষের শরীরে। আশ্চর্যের বিষয়, গল্পেও কিন্তু ঠিক এইভাবে প্রথমে ইঁদুরদের মৃত্যু এবং তাদের অনুসরণ করে মানুষের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে এই ঘটনাই হয়তো রূপান্তরিত হয়েছে বাঁশিওয়ালার গল্পে। অনেকে আবার বাঁশিওয়ালার সুরে শিশুদের নাচতে নাচতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে অন্য একটি ঘটনার ইঙ্গিত পান।

সেটিও অবশ্য এক দুরারোগ্য ব্যাধির আক্রমণের ঘটনা। মধ্যযুগের মানুষদের বিশ্বাস ছিল, ওই রোগে আক্রান্ত হলে একমাত্র বাঁশির আওয়াজে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। পেশির টান ধরার প্রবণতা কিছুটা কমে। তা ছাড়া সে-যুগে একটা প্রথাও ছিল সহানুভূতির জন্য গানবাজনার দল নিয়ে সারা শহর ঘোরার। অনেকে এইসব ঐতিহাসিক সত্যির সঙ্গে দ্য পায়েড পাইপার অব হ্যামিলন গল্পের মিল খুঁজে পান।

এ-কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই বাশিওয়ালার গল্প সত্যি আর কল্পনার অদ্ভুত সংমিশ্রণ। কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা গল্পগাথা জন্ম দিয়েছে এই অসাধারণ আখ্যানের। বাঁশিওয়ালার গল্প শহরের নাগরিকদের কাছে ক্রমশ চরম সত্যিতে পরিণত হয়েছে।

পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিক সত্য। আসলে ১৪ শতকে প্লেগ রোগে মৃত্যু হলে অনেকেই তা পাপের জন্য বিধাতার শাস্তি বলে মনে করত। এই শাস্তি'র উদ্দেশ্যই কাব্যিক ব্যঞ্জনা পেয়েছে গল্পে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য রোগের উপসর্গ, আর স্থানীয় নানা লোককথার প্রভাব। আমাদের কাছে তাই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা নিছক গল্প হলেও হ্যামিলনের বাসিন্দাদের কাছে অনেক বেশি কিছু, যেখানে বাস্তব আর কল্পনা পাশাপাশি পথ হাটছে।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.