ওয়াটারলুতের প্রান্তরে - ১ম অংশ

ওয়াটারলুতের প্রান্তরে - ১ম অংশ


আজকের দিনে ইংরেজিতে একটা প্রবাদই আছে,

টু মিট ওয়ানস ওয়াটারলু ইন।

অর্থাৎ কোনও বিষয়ে, কোনও কাজে অথবা কোনও ঘটনায় নিজের চরম দুর্গতি ডেকে আনা। ওয়াটারলু রণক্ষেত্রেই কিংবদন্তিপ্রায় বীর নেপোলিয়ন শেষ যুদ্ধ করেন।

একের পর এক যুদ্ধের দ্বারা যে-নেপোলিয়ন মাত্র বছর-পনেরোর মধ্যে গোটা ইউরোপের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন সেই তিনি এই ওয়াটারলুর যুদ্ধের পর সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন । এতবড় পদাতিক এবং অশ্ববাহিনীর সংঘর্ষ ইউরোপের ভূমিতে বড়-একটা হয়নি।

ওয়াটারলুর যুদ্ধ ঠিক দুটো বাহিনীর যুদ্ধ ছিল না। একদিকে প্রবল প্রতাপ ডিউক অব ওয়েলিংটনের নেতৃত্বে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরোপের সম্মিলিত বাহিনী; অন্যদিকে জীবন্ত ইতিহাস নেপোলিয়ন স্বয়ং এবং তাঁর ৭৪,০০০ পরাক্রমশালী ফরাসি সৈন্য।

ওয়াটারলুতের প্রান্তরে

ডিউক অব ওয়েলিংটনের কথাতেই আছে-নেপোলিয়নের সাক্ষাৎ উপস্থিতি ৪০,০০০ সৈন্যের সমতুল। উপরন্তু নেপোলিয়ন জানতেন যে, এই যুদ্ধে তাঁর না-জিতে উপায় নেই। কারণ ফ্রান্সের সিংহাসনে টিকে থাকতে হলে ইউরোপের এই মিলিত বাহিনীর মেরুদণ্ড চিরকালের মতন ভেঙে দিতে হবে। সেটা অসম্ভবও ছিল। না তাঁর পক্ষে। ছেচল্লিশ বছর বয়সী নেপোলিয়নের জীবনের এটা ছিল ষাট নম্বর যুদ্ধ।

স্থলযুদ্ধে তাঁর উপমা ইতিহাসে সম্ভবত একা তিনিই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, নেপোলিয়ন জানতেন ওয়াটারলুতে পরাস্ত হলে একটি প্রবাদ মিথ্যে হয়ে যাবে। প্রবাদটি হল :

নেপোলিয়ন চাইলে যে-কোনও পরিস্থিতিতে, যে-কোনও বাহিনীর বিরুদ্ধে জিততে পারেন।

নেপোলিয়ন নিজেও নিজেকে কিংবদন্তি বলেই মনে করতেন। এবং ওয়াটারলুর যুদ্ধ যে তিনি জিতে উঠতে পারেননি তাও নেহাতই অদৃষ্টের পরিহাস। সেন্ট হেলেনায় বন্দিজীবনে বারংবার এই যুদ্ধ তিনি কল্পনায় লড়েছেন। এবং শেষ পর্যন্ত ওয়াটারলুর পরাজয়কে তিনি যুদ্ধ-পদ্ধতির তুলের বদলে ভাগ্যের বিড়ম্বনা বলেই ধরে নিয়েছিলেন।

নেপোলিয়নকেই আমার বার বার মনে পড়েছে ওয়াটারলুর যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস শহরের উপকণ্ঠে সবুজ, বিস্তৃত ওয়াটারলু গ্রাম যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ঐতিহাসিক দিনটিতেই স্তব্ধ হয়ে আছে। গাড়িতে বিশ মিনিটের পথ গেলেই প্রাণোচ্ছল, ঝলমলে, জনাকীর্ণ ব্রাসেলস শহর। অথচ সেই শহরের কোলাহল ওয়াটারলুর ধ্যানভঙ্গ করে না।

নেপোলিয়ন
 ছবি: নেপোলিয়ন

বেলজিয়াম সরকারও অশেষ যত্নে ওয়াটারলুর সেই আদি, অকৃত্রিম রূপটুকু ধরে রেখেছেন। এমন একটা দিন যায় না, যেদিন কিছু-না-কিছু পর্যটক ওয়াটারপুর ওই সবুজ প্রান্তরে এসে অতীতের নায়কদের উদ্দেশে খানিকটা নীরব প্রার্থনা করে না যান। গ্রীষ্মের মৌসুমে ওয়াটারলু বেলজিয়ানদের আনন্দভ্রমণের উপযুক্ত স্থান। বেড়ানোর আনন্দের সঙ্গে ইতিহাসের এতখানি সান্নিধ্য পাওয়া আর কোথাও সম্ভব কি না জানি না।

খোদ ওয়াটারলুতে পৌছানোর বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই বাস থেকে একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে। একটা সবুজ পাহাড়ের মাথায় একটা অতিকায় সিংহ। সিংহটা লোহার, যে লোহা ওয়াটারলুর যুদ্ধের ভাঙা কামান, গোলা এবং বন্দুকের নল গলিয়ে বানানো।

সিংহের এক পায়ের তলায় একটা সত্যিকারের কামানের গোলা। পাহাড়ের চূড়ায় একটা ছ মিটার উঁচু পাথরের স্তম্ভের ওপর ৪.৪৫ মিটার উঁচু সিংহটিকে মাইল দুয়েক দূর থেকেও সত্যি রাজকীয় দেখায়। সিংহটির ওজন ২৮ টন। মালিনস শহরের স্থপতি ভ্যান গিলের সৃষ্টি এই সিংহ ইংল্যান্ডে এবং হল্যান্ডে রাজ্যের প্রতিভূ। ২২৮টি সিঁড়ি ভেঙে ৪৯.৫০ মিটার উঁচু পাহাড়টায় উঠে স্তম্ভের গায়ে শুধু একটা তারিখ পড়তে পেলাম। সে- তারিখ ইতিহাস কখনও ভুলবে না— ১৮ জুন, ১৮১৫ সাল। সে তারিখে নেপোলিয়নের বিশ্বজয়ী বাহিনীর গৌরব লুপ্ত হয় ওয়াটারলুর প্রান্তরে।

ওয়াটারলুর সিংহকে যে ছোট্ট পাহাড়ের চূড়ায় বসানো হয়েছে সে-পাহাড়টি কিন্তু আসল পাহাড় নয়। ওয়াটারলুর যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটনের পাশাপাশি যে-ওলন্দাজ রাজকুমার প্রিন্স অব অরেঞ্জ তাঁর ২৮,০০০ বেলজিয়ান এবং ওলন্দাজ বাহিনীর নেতৃত্ব করেছিলেন তিনি আহত হয়ে যেখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান সেখানেই ১৮২৬ সালে এই নকল পাহাড়টি সাজিয়ে তোলা হয় ।

শোনা যায়, বেলজিয়ামের সিয়েজ নগরের মহিলারা পিঠে করে মাটি এনে এনে এই পাহাড় বানাতে সাহায্য করেছিলেন। এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে আজও ওয়াটারলুকে ঠিক সেইভাবেই দেখা যায় যেমনটি কিনা যুদ্ধের দিনে নিকটের এক চূড়া থেকে দেখছিলেন ডিউক অব ওয়েলিংটন। যুদ্ধে নেপোলিয়নের হেরে যাবার একটা কারণও ছিল মিত্রশক্তির এই সুবিধাজনক অবস্থান। উপরন্তু যুদ্ধের আগের। দিনটায় বৃষ্টি হয়ে মাঠ বেশ পিছল হয়ে গিয়েছিল।

নেপোলিয়নের রণক্লান্ত সৈন্যরা তাতে রীতিমতো বেগ পেয়েছিল। এবং ভোরের সময়টায় যে প্রথম আঘাত হানলে মিত্রপক্ষ ভয়ঙ্কর কোণঠাসা হয়ে পড়ত সেটাও সম্ভব হয়নি মাঠের ভেজা অবস্থার জন্য। সেন্ট হেলেনায় বসে নেপোলিয়ন নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেননি এই অনিচ্ছাকৃত দেরিটুকুর জন্য। কারণ নেপোলিয়নের অভিধানে 'অসম্ভব' কথাটা নাকি কখনও লেখা ছিল না।

ওয়াটারলুর প্রান্তরের যেটা মুখ্য আকর্ষণ তা হল একটা গম্বুজাকৃতি বাড়ি যার ভেতরে গোলভাবে দেয়াল জুড়ে ছবিতে ছবিতে ছড়িয়ে রাখা আছে ওয়াটারলুর যুদ্ধের একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত।

কিশোর আনন্দ ৫ম খন্ড