হায়রে ঘুম!

হায়রে ঘুম!


হঠাত্‍ করে রাতুল সাহেবের নিজের ছোটকালের কথা মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে। যখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তেন তখন তো একবার স্কুলের টয়লেটে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাই তাকে খুঁজতে খুঁজতে হতাশ। শেষ-মেষ রাতে সবাই এসে স্কুলে খোঁজা শুরু করলেন আর টয়লেটে ঘুমন্ত ছোট্ট রাতুল সাহেবকে পেল। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাতুল সাহেবের এতই ঘুম ছিল যে, সে টেরই পায়নি কখন রাত হলো। 

এখন রাতুল সাহেব বড় হলেন, বিয়ে করলেন, বাবা হলেন, অন্য মেয়ের শ্বশুর হলেন কিন্তু তার গভীর ঘুম সেই আগের জায়গাতেই রয়ে গেল। ছোট্ট মুচকী হাসির সাথে এইসব ভাবতে ভাবতে তিনি আবার গভীর ঘুমে চলে গেলেন।

বাসায় থাকেন রাতুল সাহেব, তার ছেলে ও ছেলের বৌ। রাতুল সাহেবের ঘুম কেউই পছন্দ করে না শুধু মাত্র তার স্ত্রী ছাড়া।
কিন্তু সেই মানুষটিও যে এখন আর দুনিয়াতে নেই। রাতুল সাহেবের ছেলে সরকারী চাকরি করে। আর ছেলের বৌ বেসরকারী চাকরি করে। রাতুল সাহেব ও একটা বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরি করতেন কিন্তু ঘুমের কারণে সেই চাকরিটাও যায়। তার চাকরি যাওয়ার ব্যাপারটা ও মজার।

সেদিন তিনি ভালোভাবেই অফিসে গিয়েছিলেন। আর ঐ দিন অফিসে বিদেশী কোম্পানী থেকে কিছু ইনভেস্টার এসেছিল। রাতুল সাহেবের বস তাদের সাথে একটি কনফারেন্স করার জন্য ঠিক করলেন। রাতুল সাহেব যদি সেই কনফারেন্স টেবিলে নাক ডেকে ঘুমান তাহলে তো রাতুল সাহেবকে চাকরিতে রাখাটা তার বসের জন্য খুবই বিপত্তিজনক হয়ে যাবে। তাই রাতুল সাহেবের ঘুমের কথা চিন্তা করে তাকে চাকরি থেকেই বের করে দিলেন। বস তাকে শেষ কথা বলেছিলেন, ‘রাতুল সাহেব বাসায় গিয়ে আরামে ঘুমান। টেবিলে ঘুমিয়ে কষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই।’

ছেলের বউয়ের মুখে এসব কথা শুনতে রাতুল সাহেবের অসহ্য লাগছে। কিন্তু কথা তো শুনতেই হবে। কারণ আজও রাতুল সাহেবের ঘুমের জন্য আরেকটা সমস্যা বেঁধে যায়। সমস্যাটা হলো যে রাতুল সাহেব বাথরুমের কল বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়েন। আর ছেলের বউ ঘরে এসে দেখে যে রাতুল সাহেব খাঁটে নিরাপদে ঠিকই ঘুমাচ্ছেন।  কিন্তু ঘরের সকল জিনিসপত্র ১১নং বিপদ সংকেতের কবলে।

রাতুল সাহেব ছেলের বউয়ের কথা শুনতে শুনতে তার চোখটা লেগে আসে। কিন্তু তিনি আবার সজাগ হয়ে যান, কারণ এখন ঘুমালে যে রাতুল সাহেবের কপালে মঙ্গল বারেও শনি এসে পড়বে। রাতুল সাহেব চোখ বন্ধ করে ভাবে যে, তিনি কুমিল্লা তার গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন।

কুমিল্লার বাসে রাতুল সাহেব। কুমিল্লা যে তিনি নামতে পারবেন না সে তো জানা কথা। হঠাত্‍ করে তার চোখ খুলল দেখল সামনে হেলপার, ড্রাইভার ও দুই তিনজন দাড়িয়ে আছে। রাতুল সাহেব প্রশ্ন করলো, ‘এটা কোন জায়গা?’

একজন বললো, ‘কক্সবাজার’। হেলপার বললো, ‘আংকেলের না কুমিল্লা নামার কথা ছিল?’

রাতুল সাহেব হতাশার সাথে প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কী হবে?’

ড্রাইভার রহস্যময় হাসির সাথে বললো, ‘কিছুই হবে না। শুধুমাত্র আমরা আপনাকে অপহরণ করে কিছু টাকা উপার্জন করবো। হা হা।’

এইবার রাতুল সাহেবের আর ঘুম আসল না। কিন্তু অপহরণকারীরা একটা ভারী বস্তু দিয়ে রাতুল সাহেবের মাথায় বারী দিয়ে ঘুম পড়িয়ে দিলেন। পরদিন ভোরে চোখ খোলার পর রাতুল সাহেব তার অবস্থান আবিষ্কার করলেন একটা টুলের উপর হাত পাঁ বাধা।

অপহরণকারীরা তাকে এসে বলল, ‘কিরে বুইড়া সারাদিন খালি ঘুমাইবি? নাকি তোর বাড়ির ফোন টোনের নাম্বারটা দিবি?’

রাতুল সাহেব বললেন, ‘ভাই আমার হাত পা আগে খুলেন সব কইতাছি আর ভয় পায়েন না পালামু না।’

তারা রাতুল সাহেবের হাত পা খুলে দিলো। আর রাতুল সাহেবের বাসার ফোন নাম্বার চাইলো কিন্তু রাতুল সাহেব ভুল নাম্বার দিলো কারণ তার নিজেরও বাসায় যাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। আরও কিছু ভুল নাম্বারে অযথা টাকা খরচ করার পর তারা অতিষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু রাতুল সাহেবের বয়স বেশী বলে মারল না। তারা তখন গাড়ি চালাতে যাবে তাই রাতুল সাহেবকে বলল, ‘রাতে এসে যেন তারা নাম্বার পায়।’

রাতুল সাহেবের উপর চোখ রাখার জন্য একজনকে রেখে গেল। সেও বাইরে দিয়ে গেট আটকিয়ে চলে গেল। এক ঘুমের পর দুপুরে গেট দিয়ে সেই লোক খাবার হাতে প্রবেশ করলো। তারা রাতুল সাহেবকে যথেষ্ট সম্মান করে তাই ভালো খাবারই নিয়ে এলো। রাতুল সাহেব মনে মনে ভাবলেন এতো ভাল খাবার তো তিনি বাসায় ও পান না।

রাতেও ঠিক একই কাহিনী ঘটল আর খাওয়ার পর তিনি আরামের ঘুম দিল। হেলপার ও ড্রাইভার রাতে এসে রাতুল সাহেবকে ডাক দিলো কিন্তু তার গভীর ঘুমের সামনে তারাও পরাজিত হলো এবং ঘুমিয়ে পড়লো।  ভোরে রাতুল সাহেব তার ছেলের নাম্বার দিলো কিন্তু সেটা বন্ধ ছিলো। আজও তারা চলে গেল। আগের দিনের মতো আজকের দিনটাও রাতুল সাহেবের অনেক ভালো কাটলো। রাতে তারা এসে বলল, ‘এই বুইড়ারে দিয়া কোন কাম অইবো না দুইদিনে কত টাকা নষ্ট করাইয়া লাইছে।’

অবশেষে অপহরণকারীরাও তার ছেলের বউ আর ছেলের মতো রাতুল সাহেবের উপর অতিষ্ট হয়ে পড়লো। তারা ঠিক করলো রাতুল সাহেবকে মেরে ফেলবে আর মায়া করা যাবে না। কে যেন হাতে ছুঁড়ি নিয়ে রাতুল সাহেবের সামনে আসলো। রাতুল সাহেব বললো, ‘আমাকে মেরো না দয়া করে ছেড়ে দাও’।

-আব্বা আবার আপনার কী হইলো?

-ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও।

-আব্বা আপনেও আজিব! পুরা ঘর পানিতে ভাসাইয়া ফালাইছেন। দুই তিনটা বকা কিনা দিছি সেইটা শুনতে গিয়াও ঘুমাইয়া পড়লেন। আর আমি আপনারে মারমু কে?

চোখ খোলার পর দেখলেন তার ছেলের বউ ছুঁড়ি হাতে দাড়িয়ে আছে। সম্ভবত কিছু কাটছিলো।

আস্তে আস্তে রাতুল সাহেব বুঝলেন যে সবই স্বপ্ন ছিল। তিনি দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলল, ‘বাঁচা গেল।’

আবার তার ছেলের বউ বলল, ‘ভবিষ্যতে এইরকম কাজ করলে আর বাঁচবেন না, যান বাজারে যান।’

রাতুল সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে গেলেন।

-এই সেই যে বাবাকে বাজারে পাঠালাম আর তো এলো না।

-চলো খুঁজে আসি। রাতুল সাহেবের ছেলে আর ছেলের বউ চাঁয়ের দোকানে ঘুমন্ত রাতুল সাহেবকে খুঁজে বের করলো। আর দীর্ঘশ্বাসের সাথে দুজনের মুখে একই কথা আসলো, “হায়রে ঘুম!”