নীল তিমিঃ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রানী

নীল তিমিঃ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রানী


সমুদ্রের সুবিশাল নীল জলরাশিতে বসবাসকারী সবচেয়ে বড় প্রাণীর নাম হল নীল তিমি। শুধু সমুদ্র নয়, স্থলে বসবাসকারী যে কোনও প্রাণীর থেকেও আকারে বড়ো এটি। নীল তিমিকে অনেকে মাছ বললেও প্রকৃতপক্ষে মাছ নয়। এটি সাগরে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। সেই হিসেবে নীল তিমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী। চলুন আজকে জেনে আসা যাক নীল সাগরের জলরাশির নিচে রাজত্ব করা দানবাকার এই প্রাণীর সম্পর্কে। 

সাগর মহাসাগরে বিভিন্ন প্রকারের তিমির দেখা মেলে। কিলার তিমি, নীল তিমি, পাইলট তিমি, হাম্পব্যাক তিমি, বেলুগা তিমি, ফিন তিমি সহ আরও অনেক নাম। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকৃতির হলো নীল তিমি। নাম নীল তিমি হলেও এর রঙ পুরোপুরি নীল নয়। অনেকটা ধূসর কালচে নীল বর্ণের মতো। তবে সমুদ্রের নীল জলের নীচে কে দেখতে এর বর্ণ নীল দেখায়। অ্যান্টার্কটিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর সহ পৃথিবীর প্রায় সব মহাসাগরেই দেখা মেলে নীল তিমি।

নীল তিমি

আগেই বলেছি নীল তিমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী। সেটা আকার এবং ওজন দু দিক থেকেই। একটি পূর্ণবয়স্ক নীল তিমি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩০ মিটার বা একশ ফুট এর কাছাকাছি পর্যন্ত হতে পারে। যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের দ্বিগুণ। আর এর ওজন প্রায় দুইশ টন পর্যন্ত হয়। যা ৪০ টি পূর্ণবয়স্ক আফ্রিকান হাতির সমান ওজনের। এর হৃদপিণ্ডের আকার ও অস্বাভাবিক বড়। প্রায় দুটি মাঝারি আকারের প্রাইভেটকারের সমান এক একটি তিমির হৃদপীণ্ড। আর এর জীব আর ওজন প্রায় একটি হাতির সমান। যার উপর ১২ থেকে ১৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অনায়াসে দাঁড়াতে পারবেন। একটি নবজাতক নীল তিমির কিন্তু আকারে অবিশ্বাস্য বড় হয়। প্রায় ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে এক একটি নবজাতক তিমি। আর ওজন হয় প্রায় তিন টন। জন্মের পরের ছয় মাসে প্রতিদিন এরা প্রায় পাঁচশত লিটার করে দুধ পান করে।

আমরা জেনেছি যে তিমি কোনো মাছ নয়। এর কারণ মাছের কোনও বৈশিষ্টের মধ্যে বিদ্যমান নয়, শুধুমাত্র আবাসস্থল ছাড়া। তিমি মাছের মতো ফুলকার সাহায্যে অক্সিজেন নেয় না। আবার ডিমও পারে না। আর অন্য দশটা স্তন্যপায়ীর মতো নীল তিমি ফুসফুসের সাহায্যে অক্সিজেন নেয়। আর সন্তান জন্ম দেয়। তিমি ফুসফুসের সাহায্যে অক্সিজেন নিলেও মানুষের মতো এত ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের প্রয়োজন পড়ে না তাদের। ফলে পানিতে থাকতে এদের কোনও সমস্যাই হয় না। একটি নীল তিমি একবার শ্বাস নিয়ে প্রায় ৩০ মিনিট পর্যন্ত সেই নিশ্বাস ধরে রাখতে সক্ষম। ফলে একবার শ্বাস নিয়ে গভীর সাগরের ভেতরেও বিচরণ করতে পারে এরা।

নীল তিমি

নীল তিমি ক্রিল নামক চিংড়ির মতো দেখতে এক ধরণের ছোট মাছ খেয়ে জীবনধারণ করে। বিশালাকার প্রাণী তিমির কিন্তু দাঁত নেই। দাঁতের স্থলে বিশাল চালুর এর মতো ব্যালিন নামক হাড়ের তৈরি জাল থাকে। উপর থেকে নিচের চোয়াল পর্যন্ত প্রায় তিনশ ব্যালিন প্লেট রয়েছে, যা তিমি কে শিকার ধরতে সাহায্য করে। বিশালাকার তিনি যখন মুখ হাঁ করে সমুদ্রের মধ্যে ভেসে বেড়ায় তখনই এর জালে আটকা পড়ে হাজার হাজার ক্রিল। এ ভাবেই মুখ হাঁ করে সাঁতার কেটে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করে প্রাণীটি। এ ভাবে একদিনে প্রায় চার টন বা ৪০ মিলিয়ন ক্রিল মাছ আহার করে থাকে একটি নীল তিমি। যা দিয়ে অনায়াসে দুই হাজারেরও বেশি মানুষের একদিনের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

তিমির জীবনে দুটি মৌসুম থাকে। খাওয়ার মৌসুম আর প্রজনন মৌসুম। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি সাগর গুলোতে গ্রীষ্মকালে প্রচুর ক্রিল জাতীয় মাছ পাওয়া যায়। এই সময়টায় তিমিরা ব্যাপক ক্রিল আহার করে এবং প্রজনন মৌসুমের জন্য শক্তি জমাতে শুরু করে। ফলে এদের চামড়ার নিচে পুরু চর্বির স্তর জমা পরে। শরৎকালের দিকে এরা প্রজননের জন্য সঙ্গী খোঁজা আরম্ভ করে।  শীতকাল পর্যন্ত চলে এদের প্রজনন মৌসুম। প্রজনন মৌসুম শেষে গ্রীষ্মকালে এরা আবার উষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে ফিরে আসে সন্তান জন্মদান করতে। এখানে বলে রাখি, ঠাণ্ডা পানিতে তিনি সন্তান প্রসব করেন না। কারণ এই আবহাওয়ায় তিমির সন্তানদের বেঁচে থাকার জন্য বেশ প্রতিকূল। তাই সন্তান জন্মদানের পূর্বেই তারা উষ্ণ পানি সাগরের দিকে যাত্রা করে।

নীল তিমি

এবার একটি মজার তথ্য দিয়ে রাখি। নীল তিমি কিন্তু কখনওই পুরোপুরি ঘুমায় না। এর মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ সজাগ থাকে। আর বাকি অর্ধেকটা ঘুমায়। কখনওই পুরো মস্তিষ্ক একসাথে ঘুমের দেশে চলে যায় না। এর কারণ হল, যদি পুরো মস্তিষ্ক একসাথে ঘুমিয়ে পড়ে আর ঠিক সময় মতো যাতে না পারে তবে পানির মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মারা যেত তিমি। তাই সঠিক সময়ে জেগে ওঠে সমুদ্রের উপরে গিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের কাজ চালিয়ে নিতেই তিমির মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ সবসময় জেগে থাকে। আর তিনি কিন্তু প্রাণীগুলির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ শব্দে আওয়াজ তৈরি করতে পারে। এক একটি তিমির তৈরি করা আওয়াজ প্রায় দুটো জেট ইঞ্জিনের সমান এবং প্রায় ১০০০ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়।

১৯০০ সালের দিকে পৃথিবীর প্রায় সব সাগরেই নীল তিমি রাজত্ব করে বেড়াতো। কিন্তু তিমি শিকারিদের অত্যধিক শিকারের কারণেই নীল তিমি আজ বিলুপ্ত প্রায়। মূলত তিমির তেল সংগ্রহের জন্য তিমি শিকার করা হয়ে থাকে। আর বিশ্বব্যাপী তিমির তেলের অত্যাধিক চাহিদার কারণেই শিকার আরও বেড়ে যায়। ১৯০০ থেকেই ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪,০০,০০ তিমি বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারিদের হাতে মারা পড়ে। এরপর আন্তর্জাতিক তিমি কমিশন বাণিজ্যিকভাবে নীল তিমি শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন নীল তিমিকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বর্তমানে জীবিত তিমির সংখ্যা মাত্র ২৫,০০০। প্রাণী জগতের বিস্ময় এই জীবটির অস্তিত্ব আজ বিলীনের পথে। আমাদের উচিত নৈতিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় অবৈধ তিমি শিকার থেকে সরে আসা। তাহলে হয়তো একদিন আবার পৃথিবীর জীববৈচিত্রে সগর্বে স্থান করে নেবে নীল তিমি।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.