চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসের উত্থান পতন

চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসের উত্থান পতন


সুপ্রাচীন কাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আরবরা এদেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করত। বইপুস্তক আমরা এটাই পড়ে আসছি।

কিন্তু তা হলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতিষ্ঠা সাল ১৮৮৭ ধরা হয় কেন? আপনার কি এমন মনে হয়েছে, যদি কখনো চট্টগ্রাম ডুবে যায় তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন অবস্থানে পৌঁছবে?

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যিক রাজধানী। এই কথাটা কম বেশি সবারই জানা। কিন্তু এটা অনেকেই জানেন না যে,  সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে রয়েছে নানা উত্থান পতন। অবস্থানগত কারণেই বন্দর বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এই বন্দর নগরীটি ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা জেগেছে। আজকের এই ব্লগে কথা হবে চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর অবদান, ভূরাজনীতিতে এই বন্দর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? চট্টগ্রাম বন্দরে সীমাবদ্ধতা এবং এই বন্দর আদৌ কি ডুবে যাবে?

চট্টগ্রাম বন্দর

চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস বহু পুরনো। ২০০০ বছরেরও বেশি আগে থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই বন্দর ব্যবহার হয়ে আসছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম নবম শতাব্দীতে, চট্টগ্রাম বন্দর এ অঞ্চলে আরব বণিকদের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ধারণা  করা হয় চট্টগ্রাম নামের উৎস আরবদের দেওয়া শাত-উল-গঙ্গ। যার বাংলায় গঙ্গার ব'দ্বীপ। পরবর্তীতে উচ্চারণ বিবর্তিত হয়ে চাঁদগাও এবং ইংরেজিতে চিটাগং নাম ধারণ করে। যদিও তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

১৩৪৬ সালে ইবনে বতুতা সমুদ্র উপকূলে বাংলার যে বৃহত্ শহরে প্রবেশ করেন তার নাম উল্লেখ করেছিলেন সাদকাওয়ান। ঐতিহাসিকদের মতে এই সাদকাওয়ানই হচ্ছে চট্টগ্রাম। স্বাধীন সুলতানি যুগে চীনের সাথে বাংলার কূটনৈতিক যোগাযোগ হতো এই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই। ১৬ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের আগমন ঘটে এই বন্দরে। পর্তুগিজরা এই বন্দরকে পর্তুগাল দে বা বৃহৎ বন্দর হিসেবে উল্লেখ করেছিল১৩০ বছর চট্টগ্রাম পর্তুগিজ ও মগ দের আবাসস্থল এবং তাদের লুটপাট ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। পরবর্তীতে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ পর্তুগিজ ও মগ দের তাড়িয়ে অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল

চট্টগ্রাম বন্দর

জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য চট্টগ্রাম বিখ্যাত ছিল। চট্টগ্রামে যে সব জাহাজ নির্মান করা হতো সেগুলো সাধারণত কাঠে। তৈরি ছিল। শিল্প বিপ্লবের পর আধুনিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সাথে চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। স্কটিশ, ইতিহাসবিদ W. W. Hunter লিখেছেন,

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চট্টগ্রামে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় ছিল।

১৭৫৭ সালে ট্র্যাজেডির পর ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশের রাজধানী স্থাপন করে কলকাতায়। পরবর্তীতে সহজে সম্পদ পাচারের সুবিধার্থে, ১৮৭০ সালে কলকাতায় নতুন বন্দর নির্মাণ করেন। কলকাতার গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে কলকাতা বন্দরে পরিণত হয় ব্রিটিশ ভারতের প্রধানতম বন্দরে আর চট্টগ্রাম বন্দরে পরিণত হয় উপবন্দরে। ১৮৮৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে পোর্ট কমিশনারের একটি আওতায় নিয়ে আসা হয়। এবং বন্দরের বর্তমান অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। বহুল প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হচ্ছে , ১৮৮৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বরং বলা যেতে পারে ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশরা পোর্ট কমিশনার অ্যাক্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্রিটিশ ভারতের একটি বন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছিল।

চট্টগ্রামকে বলা হয় বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সর্দার। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য, অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাছাড়া দেশের শিল্প উন্নয়নে চলমান মেগা প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে রপ্তানিকারক'রা রেডিমেড গার্মেন্টস এবং চিংড়ি সহ নানাবিধ দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। এই আমদানি এবং রপ্তানি কার্যক্রমে প্রায় ৯০% সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। এই বন্দরের মাধ্যমে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রধানতম বন্দর হওয়ায় বলা যায় এটি দেশের অর্থনীতিকে আগলে রেখেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্দর ব্যবহার করে প্রতিবেশী দুই ল্যান্ড কান্ট্রি, নেপাল ও ভুটান যেমন সহজে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পন্ন করতে পারবে। ঠিক তেমনই শুল্ক আদায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারবে। আবার ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে প্রায়শই রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা বিরাজ করে। অর্থনৈতিক ভাবে অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশ পিছিয়েই রাজ্যগুলো। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার রাজ্যের যোগাযোগের একমাত্র অভ্যন্তরীণ পথ শিলিগুড়ি করিডর যেটা বেশ দুর্গম এবং ব্যয়বহুল। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারত খুব সহজে তার দুর্গম রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারবে। সম্প্রতি ভারত, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতিও পেয়েছে।

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই বন্দরের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। অগভীর হওয়ার কারণে বড় বড় মাদার ভেসেলগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। এসব জাহাজ বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থান করে। বহির্নোঙ্গর অবস্থানকারী মাদার ভেসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করা হয়। যা ব্যয়বহুল এবং সময়ের অপচয়। তা ছাড়া কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বিশ্বের উন্নত বন্দরগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৭ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর নাসার এক গবেষণায় জানা যায়, আগামী একশ বছরের মধ্যে বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে প্রায় ১৪ মিটার। এর পরে বিশ্বের ২৯৩ টি প্রধান বন্দর নগরী সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানতম বন্দর চট্টগ্রাম। সম্প্রতি যে হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে চলেছে তাতে বলা যায়, আমরা আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি হারাতে চলেছি।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.