সৌভাগ্য

সৌভাগ্য


নতুন বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে ড্রইং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলো রাতুল। আর সোফার পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিলো দশ এগারো বছরের কাজের মেয়েটি। ওর নাম শেফালি। দরিদ্র ঘরের মেয়ে। বাবা নেই। মা আছে। রাতুলদের গ্রামে ওদের বাড়ি। সেই সূত্রেই রাতুলদের চেনে। ওর মা একদিন মেয়েকে নিয়ে গ্রাম থেকে রাতুলদের বাড়িতে এসে রাতুলের মাকে বললো, মেয়েটিকে যেনো তারা রেখে দেয়। রাতুলদের এখানে থাকবে, কাজ করবে। রাতুলের মা রেখে দিলেন। তারপর থেকে মেয়েটি রাতুলদের বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে ওর মা এসে মেয়েকে দেখে যায়।

রাতুলের স্ত্রী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো, "তুমি নিচে কেনো বসেছো? সোফায় বসো।"

মেয়েটি রাতুলদের এখানে আছে দু বছর হলো। সে সব সময় নিচে বসে টিভি দেখে। তাকে কখনো তারা সোফায় বসে টিভি দেখার কথা বলেনি।

মেয়েটি তাই অবাক এবং কিছুটা ভয় নিয়ে রাতুলদের দিকে তাকালো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে।

স্ত্রী তখন উঠে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সোফায় বসালো।এবং হেসে বললো, "এখন থেকে সোফায় বসে টিভি দেখবে। কখনো নিচে বসবে না।"

মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে বসে টিভি দেখতে লাগলো। কিছুটা দূর থেকে রাতুলের মা দৃশ্যটি দেখলেন।

পরে তার মা রাতুলকে তার রুমে ডেকে বললেন, "তর সৌভাগ্য যে, তারা খুব ভালো একটা বউ পেয়েছি।"

আর তার বাবা বললেন, "বউটার যত্ন নিবি। আমি নিশ্চিত এই মেয়ে আমাদের জীবন বদলে দেবে। ঠিক যেমন তোর মা আমার জীবন বদলে দিয়েছিলো।"

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো। শহরের রাতুলদের এক খণ্ড জমি নিয়ে বারো বছর ধরে মামলা চলছিলো। জমিটির বর্তমান মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। জমিটি এক প্রভাবশালী লোক জোর করে দখল করে রেখেছিলো। কিছুদিন পর ঐ মামলার রায় হলো। এবং তারা জিতলো।

বাবা সেদিন আদালত কক্ষে রাতুলকে আবারো বললেন, "বউটার যত্ন নিবি।"

কিন্তু বাবার কথা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলো না রাতুল।

একদিন রান্নায় লবণ একটু বেশি হয়েছিলো বলে গলা চড়িয়ে স্ত্রীকে রাতুল বললো, "কী রেঁধেছো এসব! মুখেই তো দেয়া যাচ্ছে না।"

আরো বেশ কিছু কথা বললো।

বাবা তখন ছুটে এসে ধমকে রাতুলকে বললেন, "ঐ খাবার তো আমরাও খেয়েছি। কই আমাদের তো সমস্যা হয় নি।"

আর মা বললেন, "কথা ভদ্র ভাবে বলবি। বেয়াদবের মতো কথা সহ্য করবো না।"

রাতুল আর কিছু না বলে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

পরদিন অফিসে গিয়ে জানলো, বড়ো অংকের টাকার হিসেবে গণ্ডগোল হয়েছে। আর অফিসের টাকার দায়িত্ব যেহেতু রাতুলের, তাই দোষটা রাতুলের ওপর পড়লো।

বস রাতুলকে শান্ত গলায় বললেন, টাকার হিসেব যদি না মেলে তাহলে পুলিশকে জানাবেন এবং চাকরিও যাবে।

শুনে রাতুলের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। পুরো অফিস তন্নতন্ন করে খুঁজেও ঐ টাকাগুলোর সন্ধান পেল না। অফিসের বাইরে অন্য কোথাও রেখেছে কিনা তাও মনে পড়লো না। দু:সংবাদের এখানেই শেষ নয়। সেদিনই জানতে পারল, ঐ প্রভাবশালী লোক, যে রাতুলদের জমি দখল করে রেখেছিলো, উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। তার মানে, আবারো দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলবে। অর্থাৎ আরো খাটুনি এবং টাকা খরচ হবে।

বিধ্বস্ত মনে বাড়ি ফিরলো রাতুল। বাড়ি ফিরে প্রথম যে কাজটা করল তা হলো, স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইলো।

স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, "শেফালিকে স্কুলে ভর্তি করাতে চাই। আমি নিজে ওকে পড়াবো।"

অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে খানিক সময় ওর দিকে চেয়ে রইল রাতুল।  তারপর বলল, "তাহলে ঘরের কাজ করবে কে?"

"আমি শুনেছি ওর মা গ্রামে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। তুমি তাকে এখানে নিয়ে আসো। উনি আমাদের বাড়িতে কাজ করবেন। আর মা মেয়ে এক সাথে থাকলে তাদেরও ভালো লাগবে।"

তৎক্ষনাৎ রাতুল রাজি হয়ে গেল। এবং বাবা মাকে বলাতে তারাও রাজি হয়ে গেলেন।

তারপরের ঘটনা অবিশ্বাস্য! অফিসের টাকাগুলো অফিসেরই এক ড্রয়ারে খুঁজে পেল। অথচ সেদিন এতো খোঁজার পরও কেনো পাই নি কে জানে! আর দ্বিতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনা হলো, ঐ প্রভাবশালী লোকটি আচমকা মামলা তুলে নিলো। লোকটির হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণ হলো, লোকটির একমাত্র ছেলের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছিলো।

সেদিন দু হাত ভর্তি মিষ্টি নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল রাতুল তখন বাবা পুনরায় রাতুলকে বললেন, "বউটার যত্ন নিবি।"

বাবাকে তখন বলল, "আপনি সব সময় বউয়ের যত্নের কথা কেনো বলেন?"

বাবা উত্তরে বললেন, "একটা মেয়ে যখন বাবা মার বাড়ি ছেড়ে অচেনা এক বাড়িতে আসে, তখন আল্লাহ ঐ মেয়েটার মধ্যে সৌভাগ্য দিয়ে পাঠান। যারা ঐ সৌভাগ্যের যত্ন নেয়, তাদের জীবন আলোতে ভরে ওঠে। আর যারা অযত্ন করে, তাদের জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।"

স্টাডি রুমে স্ত্রী তখন শেফালিকে পড়াচ্ছিলো। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো করছে। আমি দরোজায় দাঁড়িয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালাম। সে রাতুলকে দেখে হাসলো। তখন রাতুলের মনে হলো, চাকরি এবং কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, তারচেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পেলাম স্ত্রীর হাসি মুখ দেখে।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.