মেরু ভাল্লুকঃ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিকারী প্রানী।

মেরু ভাল্লুকঃ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিকারী প্রানী।


ছোট বেলায় দুই বন্ধু আর ভাল্লুকের গল্প কে না পড়েছে? ভাল্লুকের হাত থেকে মৃতের ভান করে বেচেঁ যাওয়ার গল্পটা সবার জানা। কিন্তু, আমরা কি জানি সব ভাল্লুক মাংস আহার করে না? কিছু ভাল্লুক নিরামিষশাসীও হয়ে থাকে। তবে, ভাল্লুক নামটি শুনলেই যে আমাদের মানসপটে যে এক হিংস্র ও মাংসাশী প্রাণীর অবয়ব ভেসে ওঠে তার সবচেয়ে বড় কারন বোধহয় মেরু ভাল্লুক। অনেকে একে সাদা ভাল্লুক বলেও ডাকেন। অন্যান্য ভাল্লুকের মত এটি নিরামিষাশী বা অর্ধেক নিরামিষাশী নয়। এটি ভাল্লুকের একমাত্র প্রজাতি যারা পুরোপুরি মাংসাশী। শেতশুভ্রো বরফের মাঝে রাজত্ব করে বেড়ানো দৃষ্টিনন্দন মেরু ভাল্লুক নিয়েই আজকে জানব আমরা।

মেরু ভাল্লুক নাম থেকে বোঝা যায় যে মেরু অঞ্চলের সাথে এদের সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য উত্তর গোলার্ধের আর্টিক সার্কেলের মধ্যেই এদের বেশি দেখা যায়। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রীন ল্যান্ডের হিমশীতল পরিবেশে এরা বাস করে। এর মধ্যে পূর্ব গ্রীন ল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি মেরু ভাল্লুকের দেখা পাওয়া যায়। মূলত হিম শীতল বরফ ছাড়া এদের খাদ্য সংগ্রহ ও আবাস স্থাপন কোনোটাই সম্ভব নয়। এদের শরীরের নিচে পুরো চামড়ার স্তর থাকে। যা তাদের এই হিম শীতল প্রতিকূল পরিবেশের সাথে অভিযোজিত করে তুলেছে। এমনকি চর্বি স্তরের কারণে হিমাঙ্কের নিচে ৫০° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও এটা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে। এই পুরো চর্বি স্তরের উপরে রয়েছে কালো বর্ণের পশম। যা মেরু ভাল্লুককে আরো শীতল পরিবেশের উপযোগী করে তুলেছে। এই কালোপশমের আস্তরণের উপরে রয়েছে আবার আরেক ধরনের স্বচ্ছ লোম। এই স্বচ্ছ লোম থেকে সাদা আলোর প্রতিফলিত হয়ে আসে বলেই শীতের মৌসুমে মেরু ভাল্লুককে সাদা দেখায়। এছাড়াও মৌসুম ভেদে এদের গায়ের রং, হলুদ, হালকা বাদামী বা শেওলার কারণে সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। তবে শ্বেত শুভ্র বরফের বুকে চড়ে বেড়ানো সাদা ভাল্লুক দেখতেই সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন।

White bear

জানেন হয়তো মেরু ভাল্লুক বা সাদা ভাল্লুক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী শিকারী প্রাণীএকটি মেরু ভাল্লুক দৈর্ঘ্যের 4 মিটারের বেশি হতে পারে। আর ওজনে এরা এক টনের ও বেশি হতে পারে। তবে পুরুষ ভাল্লুকের গড় ওজন ৪০০ থেকে ৫০০ কেজির মধ্যে হয়। নারী ভাল্লুক আকারে, পুরুষ ভাল্লুকের তুলনায় অনেক ছোট হয়। ফলে এদের গড় ও যেন কম হয়। নারী মেরু ভাল্লুকের গড় ওজন প্রায়, ২৫০ থেকে সাড়ে ৩০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে

পূর্বেই বলেছি এরা পুরোপুরি মাংসাশী প্রাণী। এদের মূল খাদ্য হলো সামুদ্রিক শীল। সামুদ্রিক শীল ছাড়াও এরা খরগোশ, মৃত তিমিসহ, বিভিন্ন মাছও আহার করে থাকে। একটি ভাল্লুক দিনে প্রায় ১৯ কেজি পর্যন্ত খাবার গ্রহণ করতে পারে। অন্য মৌসুমী গ্রহণকৃত এই খাবার তাদের চামড়ার নিচে চর্বির পুরো আস্তরণ জমা করতে থাকে। শীতের মৌসুমে যখন খাদ্যের চরম অভাব দেখা দেয় তখন তারা বেঁচে থাকার জন্য এই পুরো চর্বি স্তরের উপর নির্ভর করে। শীতকালে শরীরের এই চর্বির স্তর গলে গিয়ে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। একটি মেরু ভাল্লুক প্রায় ৪ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। মেরু ভাল্লুকদের একটি চমকপ্রদ ব্যাপার হলো এরা স্থলের চেয়ে জলে বেশি দ্রুত চলাফেরা করতে পারে। ফলে দক্ষ সাঁতারু হিসেবে মেরু ভাল্লুকের সুখ্যাতি আছে। এরা ঘন্টায় প্রায় ৭ কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটতে পারে। অন্যদিকে স্থলে এরা প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার গতিতে চলাফেরা করে থাকে

White bear

মেরু ভাল্লুক সাধারণত একাকী বিচরণ পছন্দ করে। তবে প্রজননের মৌসুমে এরা সঙ্গীর সাথে মিলিত হয়। এমনিতে এরা শান্ত স্বভাবের হলেও প্রজনন মৌসুমে এরা বেশ উত্তেজিত থাকে। ফলে সঙ্গিনীর নিরাপত্তা দিতে প্রায়শই অন্য ভাল্লুকের সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে এরা। মেরু ভাল্লুক ৪ থেকে ৮ বছর বয়সের মধ্যে সন্তান জন্মদানের জন্য উপযুক্ত হয়। সাধারণত মার্চ থেকে জুন মাসের শুরু পর্যন্ত মেরু ভাল্লুকের প্রজনন মৌসুম স্থায়ী হয়। একটি নারী ভাল্লুক সাধারণত একবারে একটি সন্তান জন্ম দেন। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে দুটি বা তিনটি সন্তানও জন্ম দিয়ে থাকে। একটি নারী ভাল্লুক তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ ১৫ টি সন্তান জন্ম দিতে পারে। প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন করার পর বাবার নিজ সন্তানের উপর কোন দায়িত্ব থাকেনা। মা ভাল্লুকই সাধারণত সন্তান বড় করা ও শিকারের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এমনকি খাবারের অভাব দেখা দিলে বাবা নিজের সন্তানের জন্য বিপদজনকও হয়ে উঠতে পারে। বৈশিক উষ্ণায়নের ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় সন্তান হত্যা করে খাবার যোগানের মতো ঘটনা এখন মেরু ভাল্লুকদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়।

White bear

একটি মেরু ভাল্লুক সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ বছর বাঁচতে পারে। তবে বরফ শীতল পরিবেশ ছাড়া এরা জীবন ধারণ করতে পারে না। কিন্তু বৈশিক উষ্ণায়নের ফলে দিন দিন মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে ভাল্লুকের আবাসস্থলও। বিপন্ন হয়ে পড়ছে মেরু ভাল্লুকের প্রজাতি। বৈশিক উষ্ণায়নের ফলে যে প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির পথে রয়েছে তাদের তালিকায় সবচেয়ে উপরের নামটা মেরু ভাল্লুকের। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নেই যখন সে শুভ্র বরফের বুকে খেলে বেড়ানো দৃষ্টিনন্দন সাদা ভাল্লুক আর দেখা যাবে না। মেরু অঞ্চলে বৈশিক উষ্ণায়ন তাদের বাসস্থান ও পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতে যাচ্ছে। এমনকি খাদ্যাভাবের কারণে মেরু ভাল্লুকদের লোকালয়ে ঢুকে পড়ার ঘটনা এখন প্রায়ই শোনা যায়। হর হামেশায় সাদা ভাল্লুকের লোকালয়ে ঢুকে পড়ার ঘটনা বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়েরই ইঙ্গিত দেয়। যে কারণে মেরু ভাল্লুক সহ আরো অনেক প্রজাতির বিলুপ্তি রোধ করতে বৈশিক উষ্ণানের বিরুদ্ধে মানব জাতির এখনই সচেতন হওয়া উচিত। নয়তো কিছুদিন পর মেরু ভাল্লুকদের রক্ষায় আর বিশেষ কিছুই করার থাকবে না আমাদের।  




Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.