মিসির আলি- নিশীথিনী-০২

মিসির আলি- নিশীথিনী-০২



০২. ফিরোজ মিসির আলির কাছে আসে।


গত দু মাস ধরে ফিরোজ প্রতি সোমবারে মিসির আলির কাছে আসে। পাঁচটার সময় আসে, থাকে সাতটা পর্যন্ত। আজ কী মনে করে তিনটার সময় চলে এসেছে। মিসির আলি তখনো ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরেন নি। তাঁর কাজের মেয়ে হানিফা দরজা খুলে দিল। সে দরজা খুলল ভয়ে-ভয়ে। ফিরোজের দিকে তাকালেই তার বুক টিপটপ করে। বড় ভয় লাগে।

স্যার কি আছেন, হানিফা?

জ্বি-না।

আজ একটু সকাল–সকাল এসে পড়েছি। আমি বসি, কেমন?

জ্বি আইচ্ছা।

তুমি আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত খাওয়াতে পার? প্রচণ্ড গরম।

হানিফার বয়স দশ। কিন্তু সে খুবই চটপটে। মিসির আলি সাহেব তাকে অল্পদিনের মধ্যেই বর্ণপরিচয় করিয়েছেন। পড়াশোনার ব্যাপারে তার অসম্ভব আগ্ৰহ। মেয়েটি এমনিতেও চটপটে। সে বড় এক গ্লাস শরবত বানাল। তিন টুকরা বরফ ছেড়ে দিল। টেতে করে শরবতের গ্লাস এবং আরেক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে গেল। সে দেখেছে শরবত খাবার পরপরই সবাই পানি খেতে চায়।

ফিরোজ অবশ্যি উল্টোটা করল। পানি খেল প্ৰথমে। তারপর বেশ সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি আমাকে ভয় পাও কেন হানিফা?

ভয় পাই না তো?

পাও, খুবই ভয় পাও। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এখন সেরে গেছি। পুরোপুরি না-সারলেও অসুখটা আর নেই। চোঁচামেচি হৈচৈ কিছুই করি না। ঠিক না?

জ্বি, ঠিক।

এখন দেখা না–সবাই একা-এক ছেড়ে দেয়। আগে ছাড়ত না।

হানিফা কিছু বলল না।

ফ্যানটা ছেড়ে দাও।

হানিফ ফ্যান ছেড়ে দিল। ফিরোজ ভরি গলায় বলল, এই গরমে সুস্থ মানুষই পাগল হয়ে যায়, আর আমি তো এমনিতেই পাগল।

হানিফার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। বলে কী এই লোক! বাড়িতে আর কেউ নেই। শুনশান নীরবতা। হানিফার ইচ্ছা করতে লাগল, বাড়ির বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।

হানিফা।

জ্বি?

আমাকে ভয় লাগছে?

জ্বি।

ভয়ের কিছু নেই। আমি সেরে গেছি। ঠিক আছে।–তুমি যাও। আমি বসে থাকব। চুপচাপ।

হানিফা রান্নাঘরে চলে গেল। কি মনে করে সে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল! কেন জানি দারুণ ভয় করতে লাগল তার।

ফিরোজ বসে আছে চুপচাপ। তার চোখ ঈষৎ লাল। খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। ছেলেটির বয়স বাইশ, অত্যন্ত সুপুরুষ। চিবুক ।। মেয়ে বানাতে গিয়ে মনে করে শেষ মুহূর্তে তাকে পুরুষ বানিয়েছে, এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কিছু কাঠিন্য ঢেলে দিয়েছে।

ফিরোজের সমস্যাটা শুরু হয় এইভাবে–সে দু বছর আগে জানুয়ারি মাসে তার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। যাবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই–গ্রাম দেশে। ফিরোজ কখনো গ্রাম দেখেনি।

বন্ধুর বাড়ি ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে। চমৎকার একটা জায়গা। ভোরবেলায় আকাশের গায়ে নীলাভ গারো পাহাড় দেখা যায়। চারদিকে ধু-ধু প্ৰান্তর, বর্ষ আসামাত্র যা পানিতে ডুবে যায়। সেই পানি সমুদ্রের মতো গর্জন করতে থাকে। অল্প বাতাসেই সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ ওঠে।

এখন অবশ্যি শুকনো খটখট করছে। চারদিকে। তবু ফিরোজ মুগ্ধ হয়ে গেল। সবচেয়ে মুগ্ধ হল বন্ধুর বাড়ি দেখে-বিশাল এক দালান। সিনেমাতে পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির মতো বাড়ি। একেকটি ঘর এত উচু এবং এত বিশাল যে, কথা বললেই প্ৰতিধ্বনি হয়।

ফিরোজের বন্ধুর নাম আজমল চৌধুরী। সে তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখাল। অতিথিদের থাকবার জায়গা। নায়ারীদের থাকবার জায়গা। কুয়োতলা। বাড়ির পেছনের সারদেয়াল, যেখানে পূর্বপুরুষদের কবর আছে। ফিরোজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কী কাণ্ড। সে মুগ্ধ কষ্ঠে বলল, এ তো হুলস্থূল ব্যাপার রে আজমল! তোরা রাজা-মহারাজা ছিলি–তা তো কোনোদিন বলিস নি?

এখন কিছুই নেই। দালানটাই আছে, আর কিছুই নেই। সেই দালানই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আরেকটা ভূমিকম্প হলে গোটা দালানই ভেঙে পড়ে যাবে। তা ছাড়া খুব সাপের উপদ্রব।

বলিস কী?

এখন ভয় নেই কোনো সব সাপ হাইবারনেশনে চলে গেছে; গরমের সময় ভয়াবহ কাণ্ড হয়!

কোনো ব্যবস্থা করতে পারিস না?

আজমল কঠিন স্বরে বলল, এর একটামাত্র ব্যবস্থাই আছে, সব ছেড়েছুড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া।

এত চমৎকার ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি, বলিস কী!

চলে যাব। এখানে থাকলে মারা পড়তে হবে। তিনিটামাত্র মানুষ আমরা। আমি, মা আর আমার ছোটবোন। এত বড় বাড়ি দিয়ে আমি করব কী? জঙ্গল হয়ে গেছে চারদিকে, দেখছিস না?

দু দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে ফিরোজ গিয়েছিল, কিন্তু পঞ্চম দিনেও সে ফেরার কথা কিছু বলল না।

বড় আনন্দে সময় কাটতে লাগল। গ্রাম যে এত ইন্টারেষ্টিং হবে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। শুধু একটি খটকা লেগে থাকল। তার মনে। আজমলের বোনের সঙ্গে তার দেখা হল না, যদিও মেয়েটি এই বাড়িতেই থাকে। মেয়েটির নাম-নাজ। আজমলের মা প্রায়ই তাঁর মেয়েকে চিকন গলায় ডাকেন, ও নাজ, ও নাজ। তার উত্তরে মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে সাড়া দেয়। মেয়েটির সাড়াশব্দ এইটুকুই। ফিরোজ এক বার ভেবেছিল, আজমলকে তার বোনের কথা জিজ্ঞেস করে। শেষ পর্যন্ত তা করা হয় নি। প্রাচীনপন্থী একটি পরিবার, হয়তো কিছু মনে করে বসবে। এদের হয়তো কঠিন পর্দার ব্যাপার আছে।

ষষ্ঠ দিন সন্ধ্যায় মেয়েটির সঙ্গে ফিরোজের দেখা হয়ে গেল। ফিরোজ অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যাবেলা। চারদিক অন্ধকার। ঘরে স্মালো দিয়ে যায় নি। ফিরোজ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই হকচাকিয়ে গেল! সতের-আঠার বছরের একটি মেয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে একটি হারিকেন। হারিকেনের আলো পড়েছে মেয়েটির মুখে। এই মুখ কি কোনো মানবীর মুখ? অসম্ভব। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত রূপ কি এই মুখে আঁকা নয়? ফিরোজ চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইল–পারল না। সে তাকিয়েই রইল।

মেয়েটি বলল, আমি নাজনীন।

কিছু-একটা বলতে হয়। ফিরোজ বলতে পারল না। কোনো কথা তার মনে এল না। এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটিকে সে কী বলবে?

ভাইয়া বাজারে গেছে, এসে পড়বে। আপনি বড় ঘরে বসুন–চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ফিরোজ বড় ঘরের দিকে রওনা হল। আচ্ছানের মতো, এবং সে মনে করতে পারল না মেয়েটির গায়ে শাড়ি ছিল, না সালোয়ার-কামিজ ছিল। মেয়েটির চুল কি বেণী-বাঁধা ছিল, না খোলা ছিল। তার মুখটি কি গোলাকার, না লম্বাটে। কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে একটি তুলি দিয়ে আঁকা মুখ সে দেখে এসেছে। যে-শিল্পী ছবিটি একৈছেন তাঁর বাস এ পৃথিবীতে নয়। অন্য কোনো ভুবনে।

রাতে খাবার সময় আজমল সহজ স্বরে বলল, নাজের সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে, তাই না? নাজ বলছিল।

ফিরোজ কিছু বলল না। আজমল বলল, ও কিছুতেই তোর সামনে আসতে চাচ্ছিল না। দেখাটা সে-জন্যেই এমন হঠাৎ হয়েছে।

আসতে চাচ্ছিল না কেন?

লজ্জা। ওর পোলিওতে একটা পা নষ্ট। এই লজ্জায় সে কারো সামনে পড়তে চায় না।

আজমলের মুখ কঠিন হয়ে গেল। সে রুক্ষ স্বরে বলল, পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা তার মধ্যে। শুধু তোর সামনে কেন, কারো সামনেই সে যায় না।

সমস্ত রাত ফিরোজ এক ফোঁটা ঘুমতে পারল না। এত কষ্টের রাত তার জীবনে আসে নি। এবং ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটল পরদিন দুপুরে।

সে এক-একা শিয়ালজানি খালের পাড় ধরে হাঁটতে গেল। এবং তার এক ঘন্টার মধ্যেই চার-পাঁচ জন লোক তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। তার চোখ লাল টকটক করছে। দৃষ্টি উদ্‌ভ্রান্ত। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে! কথাবার্তা অসংলগ্ন। মাঝে-মাঝে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠছে এবং দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে।

আজমল এবং তার মা হতভম্ব। নাজনীন সমস্ত ব্যাপার দেখে অনবরত কাঁদছে। বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে মানুষে। নানান জল্পনা-কল্পনা। খারাপ বাতাস লেগেছে। জিনে ধরেছে। কালীর আছর হয়েছে।

ফিরোজকে নিয়ে আসা হল ঢাকায়। সারিয়ে তুললেন মিসির আলি সাহেব। সেই সারানোর ব্যাপারটা সাময়িক। কিছুদিন সুস্থ থাকে, আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। লোকজনদের গলা টিপে ধরতে চায়। জিনিসপত্র ভেঙে একাকার করে।

তবে এখন অবস্থা অনেক ভালো। অসুস্থতার সময় আগের মতো ভায়োলেন্ট হয় না। চুপ করে থাকে। কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে। ঘর থেকে শুধু বিড়বিড় শব্দ শোনা যায়। যেন সে কারো সঙ্গে কথা বলছে।

যখন সে সুস্থ থাকে, তখন তার অসুস্থ অবস্থার কথা বিশেষ মনে থাকে না। মিসির আলি সাহেব খুটিয়ে খুঁটিয়ে যা বের করেছেন, তা খাতায় লিখে রেখেছেন। লেখা হয়েছে ফরোজের জবানিতে।

অসুস্থতার বিবরণঃ

সারা রাত নানান কারণে আমার ঘুম হয় নি। শেষ্যরাতের দিকে একটু ঘুম এল। তাও অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। ছাঁটার সময় বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দেখি, আজমল একটা চাদর গায়ে দিয়ে আমবাগানে রোদের জন্যে অপেক্ষা করছে। চট করে রোদ উঠবে মনে হল না। কারণ খুব কুয়াশা। আমি লক্ষ করেছি, আটটা-নটার আগে এ অঞ্চলে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না।

আজমল আমাকে দেখে বলল, আজ এত সকাল-সকল উঠলি যে? চোখ লাল কেন? রাতে ঘুম হয় নি?

হয়েছে।

চা খাবি এক কাপ? নাশতা হতে দেরি হবে। চাল কোটা হচ্ছে, পিঠা হবে; সময় লাগবে।

চা এক কাপ খাওয়া যায়।

চা খেতে-খেতে পাখি শিকার নিয়ে কথা হল। এখান থেকে প্রায় মাইল চারেক দূরে পুকইরা বিলে নাকি খুব হাঁস নামছে। শেষ রাতে উঠে গেলে প্রচুর পাওয়া যাবে। আমি হাস মারার ব্যপারে যথেষ্ট উৎসাহ দেখলাম, কিন্তু আজমলের কাছ থেকে কোনোরকম সাড়া পাওয়া গেল না। অথচ এখানে যার সঙ্গেই দেখা হয়, সেই জিজ্ঞেস করে পাখি শিকার করতে এসেছি কি না। আজমলের এ রকম অনগ্রহের কারণ নাশতা খাবার সময় টের পাওয়া গেল। এদের পাখি মারার কোনো বন্দুক বৰ্তমানে নেই। একটা দোনলা উইনস্টন গান ছিল। অর্থনৈতিক কারণে বিক্রি করে ফেলতে হয়েছে। শিকারের প্রসঙ্গ উঠতেই এই কারণেই আজমল মন খারাপ করেছে। আমার নিজেরও তখন একটু খারাপ লাগল। শিকারের প্রসঙ্গটা না-তুললেই হত।

রোদ উঠল দশটার দিকে। আমি ভেবেছিলাম, আজমলের সঙ্গে বাজারের দিকে যাব। কিন্তু আজমল বলল, তুই থাক, আমি দেখি একটা বন্দুকের ব্যবস্থা করা যায় কি না।

আমি বললাম, বন্দুকের ব্যবস্থা করার কোনো দরকার নেই। শিকারের দিকে আমার কোনো ঝোঁক নেই।

আজমল আমার কোনো কথা শুনল না। সে অসম্ভব জেদি। আমাকে রেখে চলে গেল। আমার তেমন-কিছু করার নেই। শিয়ালজানি খাল ধরে ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

এ–অঞ্চলে হিন্দু বসতি খুব বেশি। এদের ঘর-দুয়ার খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দেখতে ভালো লাগে। তবে অনেক বাড়ি-ঘর দেখলাম ফাঁকা। আজমলের কাছে শুনেছি, অনেক হিন্দু পরিবার একাত্তুরের যুদ্ধে কলকাতা গিয়ে আর ফিরে আসে নি। বেশ কিছু মারা পড়েছে পাকিস্তানি আর্মির হাতে। এদের ঘর-বাড়ি ফাঁকা। বড় বড় ঘাস জন্মেছে। জনমানবশূন্য বাড়ি-ঘর দেখতে কেমন যেন ভয়ভয় লাগে। গা ছমছম করে।

আমি ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে যাব। চড়চড় করে রোদ উঠছে। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। হাঁটতে-হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি। যে–জায়গাটায় আছি, তা অসম্ভব নির্জন। আমি বিশাল একটা বকুলগাছের নিচে দাঁড়ালাম খানিকক্ষণ। তখনই ব্যাপারটা ঘটল। গরগর একটা শব্দ শুনলাম গাছে যেন কেউ গাছের ডাল নাড়াচ্ছে। আমি চমকে গাছের দিকে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল।

দেখলাম, গাছের ডালে এক জন মানুষ বসে আছে। খালি গা। পরনে একটা প্যান্ট। চোখে গোন্ড রিম একটা চশমা। লোকটি রোগা এবং দারুণ ফর্সা। মুখের ভাব অত্যন্ত রুক্ষ। সে সাপের মতো সরসর করে নেমে এল। এক জন মানুষ গাছ থেকে নেমে আসার মধ্যে তেমন অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু আমার শরীর কাঁপতে লাগল। ঘামে গা চটচটে হয়ে গেল। লোকটির দৃষ্টি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ চশমার কাঁচের আড়ালেও তার চোখ চকচক করছে। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল আমার দিকে। আমার প্ৰচণ্ড ইচ্ছা করছিল ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু আমার পা যেন মাটিতে লেগে গেছে। নডুবার সামথ্য নেই। লোকটির কাছ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবারও ক্ষমতা নেই। সে এগিয়ে এল আমার দিকে, তারপর একটা চড় বসিয়ে দিল। এর পরের ঘটনা আমার আর কিছুই জানা নেই।

মিসির আলি সাহেব তাঁর ছোট-ছোট অক্ষরে প্রচুর নোিট লিখেছেন। প্রায় পঁচিশ পৃষ্ঠার একটি বিশ্লেষণী প্ৰবন্ধও আছে ইংরেজিতে লেখা। কিছু পয়েন্টস আছে আন্ডারলাইন করা। দু-একটি পয়েন্ট এ রকম :

১। ফিরোজের গল্পে বেশ কিছু মজার ব্যাপার আছে। সে চশমা-পরা একটি লোককে নেমে আসতে দেখল। খালিগায়ে। কিন্তু তার পরনে আছে প্যান্ট। যে-লোকটি চশমা এবং প্যান্ট পরে, সে খালিগায়ে থাকে না। লুঙ্গি-পরা একটি লোক খালিগায়ে নেমে এলে বাস্তব চিত্র হত; ফিরোজ দেখেছে একটি অবাস্তব চিত্র! অবাস্তব চিত্রগুলো আমরা দেখি স্বপ্ন। ফিরোজ কি একটি বর্ণনা করছে?

২। ফিরোজ বলছে লোকটির পরনে ছিল প্যান্ট। কিন্তু প্যান্টের রঙ কী, তা সে বলতে পারছে না। তার মানে কি এই যে, প্যান্টের কোনো রঙ ছিল না। স্বপ্নৰ্দশ্য সবসময় হয় সাদা-কালো! স্বপ্ন বৰ্ণহীন। অবশ্যি সে একটি রঙ স্পষ্ট উল্লেখ করছে। সেটি হচ্ছে চশমার ফ্রেমের রঙ। সে বলছে গোন্ড রিম চশমা। অথাৎ সে সোনালি রঙ দেখতে পাচ্ছে, স্বপ্ন দৃশ্যে যা সম্ভব নয়।

৩। তার গল্পের কোথাও সে নাজনীন প্ৰসঙ্গ উল্লেখ করে নি। আমার মনে হচ্ছে, ফিরোজের সমস্ত ব্যাপারটায় নাজনীনের একটি ভূমিকা আছে। অসুস্থ হবার আগের রাত সে অনিদ্রায় কাটিয়েছে। অনিদ্রার মূল কারণ রূপবতী একটি মেয়ে। আমি লক্ষ করেছি, আমার সঙ্গে কথাবার্তারি সময়ও সে এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়। কোন যায়?

৪। সে তার গল্পে বলেছে, সে একটি বকুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু যেগাছের নিচে সে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা একটা বটগাছ। ফিরোজ বকুলগাছ এবং বট গাছের পার্থক্য জানবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে গাছের নিচে আসার আগেই একটি ঘোরের ভেতর ছিল বুলে আমার ধারণা। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস বকুলগাছ প্রসঙ্গে তার কোনো একটি পীড়াদায়ক স্মৃতি আছে। (পরে বকুলগাছ প্রসঙ্গে আরো তথ্যাদি আছে)।

৫। ফিরোজের চশমাপরা লোকটি ছিল ফস, রোগ ও লম্বা, যার চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বর্ণনা আজমলের বেলায়ও খাটে। এই ছেলেটি অসম্ভব ফস, রোগা এবং লম্বা। সে অবশ্যি চশমা পরে না, মেডিকেল কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়বার সময় তার চশমা ছিল। এবং সেটা ছিল গোন্ড রিম চশমা। সেই সময় ফিরোজ এবং আজমল ছিল রুমমেট।

ফিরোজ প্রসঙ্গে ইংরেজিতে কিছু নোট আছে। নোটগুলোর বঙ্গানুবাদ দেয়া হল :

বকুলগাছ বিষয়ে কয়েকটি কথা:

আমার প্রাথমিক অনুমান ছিল বকুলগাছ প্রসঙ্গে ফিরোজের একটি পীড়াদায়ক স্মৃতি আছে। অনুমান মিথ্যা নয়। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ফিরোজরা একসময় সিলেটের মীরবাজারে থাকত। তার বাসা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে একটি বকুলগাছ ছিল। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা খুব ভোরবেলায় বকুল ফুল কুড়াতে যেত।

ফিরোজের বয়স তখন আট বছর। সে তার বড় বোনের সঙ্গে এক ভোরবেলায় ফুল কুড়াতে গিয়ে একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখল। একটি নগ্ন যুবতীর মৃতদেহ দড়িতে ঝুলছে। এটি একটি হত্যাকাণ্ড। মেয়েটিকে মেরে দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

অল্পবয়স্ক একটি শিশুর কাছে নগ্ন নারীদেহ এমনিতেই যথেষ্ট অস্বাভাবিক। সেই দেহটি যদি প্রাণহীন হয়, তাহলে তা সহ্য করা মুশকিল।

ফিরোজ অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রবল জ্বর এবং ডেলিরিয়াম। শৈশবের এই দৃশ্য ফিরোজের মস্তিষ্কের নিউরোনে জমা আছে, তা বলাই বাহুল্য।

মিসির আলি সাহেব বাড়ি ফিরলেন পাঁচটা বাজার কিছু পরে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ক্ষণেক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক ঝাঁকে-ঝাঁকে কাক উড়ছে আকাশে। ঝড় হবে সম্ভবত। পশু-পাখিরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খবর আগে–আগে পায়।

ঘরে ঢুকে যে-দৃশ্যটি দেখলেন, তার জন্যে মিসির আলির মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। ফিরোজ বসে আছে মূর্তির মতো। তার হাতে একটা লোহার রড। সে শক্ত হাতে রড চেপে ধরে আছে। এত শক্ত করে চেপে ধরে আছে যে, তার হাতের আঙুল সাদা হয়ে আছে। চামড়ার নিচের শিরা নীল হয়ে ফুলে উঠেছে।

রড সে পেল কোথায়? এই প্রশ্নটির উত্তর পরে ভাবলেও হবে। ঠিক এই মুহূর্তে তাঁকে বুঝতে হবে, ফিরোজ এ-রকম আচরণ কেন করছে। তিনি সহজ স্বরে বললেন, একটু দেরি করে ফেললাম। তুমি কি অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছ নাকি?

ফিরোজ জবাব দিল না। তার চোখ টকটকে লাল। নিঃশ্বাস ভরি। কী সৰ্ব্বনাশের কথা! মিসির আলি প্ৰাণপণে চেষ্টা করলেন স্বাভাবিক থাকতে।

বুঝলে ফিরোজ, খুব ঝড়-বৃষ্টি হবে। আকাশ অন্ধকার হয়েছে মেঘে। তোমার হাতে ওটা কি লোহার রড নাকি?

হুঁ।

লোহার রড নিয়ে কী করছ? দাও, রেখে দিই।

চা-টা কিছু খেয়েছ?

ফিরোজ কোনো জবাব দিল না। তার দৃষ্টি তীব্র ও তীক্ষ্ণ।

সিগারেট খাবে? নাও, একটা সিগারেট ধরাও।

আশ্চর্যের ব্যাপার, ফিরোজ রড ছেড়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল। মনে হচ্ছে একটা ভয়াবহ বিপর্যয় এড়ানো গেছে। সিগারেট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত সে এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সিগারেট শেষ হতে লাগবে তিন মিনিট। তিন মিনিট যথেষ্ট দীর্ঘ সময়!

তোমার জ্বর নাকি ফিরোজ?

ফিরোজ জবাব দিল না। মিসির আলি তার কপালে হাত দিলেন। গা ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ, বেশ জ্বর তো! একটা ট্যাবলেট খেয়ে নাও, জ্বরটা কমবে।

তিনি ড্রয়ার খুলে এক শ মিলিগ্রাম লিব্রিয়ামের ট্যাবলেট বের করলেন। অত্যন্ত কড়া ঘুমের অষুধা! কোনোরকমে খাইয়ে দিতে পারলে সঙ্গে-সঙ্গে কাজ করবে। সেন্ট্রাল নাভসি সিষ্টেমে গিয়ে ধরবে। মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহের পরিমাণ কমে আসবে। উত্তেজিত অংশগুলোর উত্তেজনা দ্রুত হ্রাস পাবে। লিব্লিয়াম একটি চমৎকার অষুধ।

নাও ফিরোজ, খেয়ে নাও!

ফিরোজ কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই অষুধ খেয়ে ফেলল। রক্তে অষুধ মেশবার জন্যে সময় দিতে হবে। বেশি নয়, অল্প কিছু সময়। এই সময়টা গল্পগুজবে আটকে রাখতে হবে।

চা খেলে কেমন হয় ফিরোজ? বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে চা-টা জামবে মনে হয়। খাবে?

হুঁ, খাব।

বস, আমি চা নিয়ে আসছি। কিংবা এক কাজ কর। শুয়ে পড় সোফায়–আরাম কর।

মিসির আলি বেরিয়ে এলেন। শোবার ঘরের দরজা লাগিয়ে এলেন বারান্দায়। এখন তিনি নিশ্চিন্তু বোধ করছেন। ফিরোজকে বারান্দায় এলে দরজা ভেঙে আসতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর মধ্যেই লিব্লিয়াম তার কাজ করতে শুরু করবে।

মিসির আলি ডাকলেন, হানিফা, হানিফা।

হানিফা রান্নাঘরের দরজা খুলে বের হয়ে এল। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। সে কাঁপছে থারথার করে।

কী হয়েছিল হানিফা?

হানিফা কিছু বলতে পারল না। আতঙ্ক এখনো তাকে ঘিরে আছে। মিসির আলি সাহস দেবার জন্যে হানিফার মাথায় হাত রাখলেন। হানিফা ক্ষীণ স্বরে বলল, এই লোকটা একটা লোহার শিক লইয়া আমারে মারতে আইছিল।

তারপর?

আমি দরজা বন্ধ কইরা বইসা ছিলাম। তারপর শুনি সে কার সাথে যেন কথা কইতেছে।

কার সাথে কথা বলছে?

অন্য একটা মানুষ।

তুমি দেখেছি অন্য কোনো মানুষ?

জ্বি না, কিন্তু কথা শুনছি। মোটা গলা।

ঠিক আছে এখন যাও, ভালো করে এক কাপ চা বানাও। ভয়ের কিছু নেই।

হানিফা চা বানাতে গেল। মিসির আলি লক্ষ কৰলেন, মেয়েটির পা এখনো কাঁপছে। চা বানাতে-বানাতে ঠিক হয়ে যাবে। ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, কোনো এক্সারসাইজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা!

মিসির আলি ঘড়ি দেখলেন। দশ মিনিট পার হয়েছে। লিব্রিয়াম নিশ্চয়ই তার কাজ শুরু করেছে। বসার ঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। এখন নিশ্চিন্তে সেখানে যাওয়া যায়।

তিনি বসার ঘরে ঢুকলেন। ফিরোজ লোহার রড হাতে বসে আছে। অসুখের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। তিনি শুকনো গলায় বললেন, চা বানাতে বলে এসেছি। চা চলে আসবে।

ফিরোজ চাপা গলায় বলল, আজ আপনার একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা করবার কথা।

মিসির আলির চমকে ওঠা উচিত, কিন্তু তিনি চমকে উঠলেন না। তিনি জানেন, বিশেষ-বিশেষ অবস্থায় মানুষের টেলিপ্যাথিক সেন্স প্রবল হয়ে ওঠে। ফিরোজের এখন সেই অবস্থা। সে ব্যাখ্যার অতীত কোনো- একটি উপায়ে তাঁর মস্তিকের বায়োকারেন্ট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্ৰহ করছে।

একটি মেয়ের সঙ্গে আপনার দেখা করবার কথা না?

হ্যাঁ, কথা আছে।

তার কাছে গেলে আপনার বিপদ হবে।

কী করে বুঝলে?

আমাকে বলে গেছে!

কে বলে গেছে? ঐ চশমাপরা লোক?

হ্যাঁ।

মিসির আলি লক্ষ করলেন, ফিরোজের চোখের পাতা ঘনঘন পড়তে শুরু করেছে। REM–র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট। লিব্রিয়াম কাজ করতে শুরু করেছে।

তিনি সহজ স্বরে বললেন, শোন ফিরোজ, আমি আমার সারা জীবনে আমার নিজের লাভ-ক্ষতির দিকে তাকাই নি। আমি ঐ মেয়েটির কাছে যাব।

ফিরোজ ঘুমিয়ে পড়ল।

বাইরে গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। ফিরোজকে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠিয়েছেন তার বাবা-মা।

মিসির আলি ড্রাইভারকে নিয়ে ধরাধরি করে ঘুমন্ত ফিরোজকে গাড়িতে তুলে দিলেন। ড্রাইভারকে বললেন, ও অসুস্থ। আজরাতটা ওকে তালাবন্ধ করে রাখতে হবে। সকালবেলা আমি ওকে দেখতে যাব। আর শোন, ও রাতে বিড়বিড় করে কথাটথা বলবে। একটা ক্যাসেট রেকর্ডারের ব্যবস্থা করতে বলবে, যাতে ওর সমস্ত কথাবার্তা রেকর্ড হয়ে যায়। এটা খুব দরকার।

ড্রাইভার শুকনো মুখে তাকিয়ে রইল। মিসির আলি ঘরে পা দিতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। সেই সঙ্গে বাতাস। এ-ব্লকম দুযোগের রাতে নীলুর কাছে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না; মিসির আলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন।

ফিরোজের ব্যাপারে তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেছে। হঠাৎ এ-রকম হবে কেন?


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.