
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মব জাস্টিসের নির্মম পরিণতি!
তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ড
তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ড ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ঘটে। এক মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি, তোফাজ্জল হোসেন, শিক্ষার্থীদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়। মোবাইল চুরির অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং পরে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। প্রধান ছয় অভিযুক্ত সকলেই ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ছিলেন।
প্রেক্ষাপট
তোফাজ্জল হোসেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তার পিতা আব্দুর রহমান ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এবং একই বছরে তার মা বিউটি বেগম ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২৩ সালের ৭ এপ্রিল তার বড় ভাই নাসির উদ্দিন, যিনি বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন, ক্যান্সারে মারা যান। একাধিক পারিবারিক শোকের কারণে তোফাজ্জলের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন এবং শিক্ষার্থীদের দেওয়া খাবার গ্রহণ করতেন।
ঘটনা
একটি ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন মোবাইল চুরির অভিযোগে শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জল হোসেনকে আটক করে এবং ফজলুল হক মুসলিম হলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ছাত্রলীগের তিনজন নেতা ও দুইজন সক্রিয় সদস্য তাকে ক্রিকেট ব্যাট ও স্টাম্প দিয়ে পেটায়।
প্রথমে তাকে হলের ক্যান্টিন থেকে খাবার দেওয়া হয়, কিন্তু খাবার খাওয়ার পরপরই তাকে আবারও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। শিক্ষার্থীরা তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ দাবি করে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও তৎক্ষণাৎ তাকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রতিক্রিয়া
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও একটি মব জাস্টিসের ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না শুধু দুঃখ প্রকাশের জন্য সরকারের সমালোচনা করেন এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মব জাস্টিসের এই ঘটনার সমালোচনা করে বলেন,
"এক বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরশাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, একদল লোক এখন বিশ্বাস করে যে তারা তাদের ইচ্ছামতো গণবিচার ও মব জাস্টিস দিতে পারে এবং কর্তৃপক্ষকে যা বলবে, তা তারা মেনে চলবে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, যেমন ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স এবং স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট রিপ্রেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের আয়োজন করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাম গণতান্ত্রিক জোট অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানায়। গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি এই হত্যাকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন।
গ্রেপ্তার ও বিচার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আমানউল্লাহ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুলিশ ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করে। এই ছয়জনের মধ্যে তিনজন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং দুইজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ২০ সেপ্টেম্বর, আটককৃত ছয় শিক্ষার্থী আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরও দুই সন্দেহভাজন শিক্ষার্থীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
আসামিদের তালিকা
ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, তোফাজ্জলকে মারধরের ঘটনায় প্রায় ১৫ জন শিক্ষার্থী জড়িত ছিল। তারা পূর্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রধান ছয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নাম | বিভাগ | সেশন | রাজনৈতিক দল |
---|---|---|---|
মো. জালাল মিয়া | পদার্থবিজ্ঞান | ২০১৮-১৯ | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক, ছাত্রলীগ |
আল হুসাইন সাজ্জাদ | ভূগোল | ২০২০-২১ | এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের দপ্তর সম্পাদক, ছাত্রলীগ |
আহসান উল্লাহ | গণিত | ২০১৮-১৯ | ফজলুল হক মুসলিম হলের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপসম্পাদক, ছাত্রলীগ |
সুমন মিয়া | মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ | ২০২১-২২ | সক্রিয় কর্মী, ছাত্রলীগ |
ওয়াজিবুল আলম | সমুদ্রবিজ্ঞান | ২০২১-২২ | সক্রিয় কর্মী, ছাত্রলীগ |
মো. মোত্তাকিন সাকিন শাহ | পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান | ২০২১-২২ |
উপসংহার
তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে মব জাস্টিসের একটি ভয়াবহ উদাহরণ। এই ঘটনা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক নিন্দার ঝড় তোলে এবং ন্যায়বিচারের দাবি ওঠে। রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।