টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০২
আপনি যদি নেহাতই গুহাবাসী মানব না হয়ে থাকেন বা ইন্টারস্টেলার মুভির কুপারের মতো মহাকাশ ভ্রমণ থেকে সদ্য ফেরত না হন তাহলে ইতোমধ্যে টিকটক আপনার কাছে সুপরিচিত। MAKE YOUR DAY: REAL PEOPLE, REAL VIDEO এই স্লোগান নিয়ে ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই চাইনিজ ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম বর্তমানে তুমুল জনপ্রিয়। ছেলে থেকে বুড়ো, সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটি কে নেই প্ল্যাটফর্মে? বিশেষ করে প্যানডেমিকের ভেতরে টিকটক এর প্রসার বেড়েছে হু হু করে। অখণ্ড অবসরে কেউ হয়তো নিছক বিনোদনের জন্য ভিডিও বানাচ্ছে। আবার কেউ বা টিকটকে যাচ্ছে সব বাহারি কনটেন্ট দেখবার জন্য। দিনকে দিন ইউজারের সংখ্যা এতটাই বেড়ে চলেছে যে সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়াকেও পেছনে ফেলেছে টিকটক।
তবে ব্যাপারটা কী জানেন?
কোনও কিছুর groth যখন হঠাৎ করে জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করে সেটার দিকে আগানোর আগে কিঞ্চিৎ মস্তিষ্কে সদ্ব্যবহার করাটা বুদ্ধিমানের পরিচয়। বিনোদনের সস্তা চকচকে ফয়েল পেপারে মোড়ানো জগতটার অলিগলিতে হেঁটে বেরিয়েছি আমরা। সেই পদব্রজের দ্বিতীয় কিস্তি আজ।
টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০১
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একজন মানুষ গড়ে মাসে ২৬ ঘণ্টা টিকটক কন্টেন্ট দেখে। যেখানে গড় মাসিক ইউটিউব কনটেন্ট কনজাম্পশন সময় ১৬ ঘণ্টা। অর্থাৎ ইউটিউব থেকে ঢের বেশি সময় মানুষ এখন কাটাচ্ছে টিকটকে।
কারণটা কী বলুন তো?
এক কথায় যদি উত্তর দিতে হয় তাহলে তা হল ডোপামিন। হ্যাঁ, সেই ডোপামিন যা আপনার মস্তিষ্কে বয়ে আনে আনন্দ উদ্দীপনার ঢেউ। যে কাজ করলে মস্তিষ্ক সহজেই ডোপামিন খরচ করতে পারবে, সেই কাজে আসক্ত হয়ে যাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
ডোপামিন হল একটি হরমোন এবং ক্যাটেকোলামাইন ও ফেনাথ্যালামিন এর একটি নিউরোট্রান্সমিটার। যা মানব মস্তিষ্ক ও শরীরে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডোপামিনের প্রধান কাজ হল আচরণের নিয়ন্ত্রণ, এবং মোটিভেশন। এটি আমাদের আনন্দ, উদ্দীপনা, এবং উদ্দেশ্য বোধের সাথেও জড়িত।
আপনার আশেপাশে নিশ্চয়ই অনেকেই আছেন যারা নিয়মিত ধূমপান করে থাকেন। একবার ভাবুন তো তারা কি জানে না যে ধূমপান তাদের জন্য ক্ষতিকারক? নিশ্চয়ই জানেন। তারপরও তাঁরা কেন এ মরণ নেশা ছাড়তে পারে না? কারণ কিন্তু সেই ডোপামিন। ধূমপান করলে তাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন ক্ষরণ হয়। ফলে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করেন তাঁরা।
টিকটকের অ্যালগরিদম ও এমন ভাবে ডিজাইন করা যাতে আপনি খুব সহজেই ডোপামিন ক্ষরনের মজাটা পান। আর বারবার ডোপামিন ক্ষরণ হতে থাকলে তখন আর টিকটক থেকে বেরোতেই মন চায় না। আর সময় যে কোথা থেকে কোথায় গড়িয়ে যায় সে হিসেব মেলানোই দুষ্কর হয়ে পড়ে। টিকটকের ভিডিও গুলো হয় বেশ ছোট। কাজেই তা দেখার সময় ডোপামিন ক্ষরণ এর জন্য আপনাকে খুব বেশি সময় ধৈর্য ধরে থাকতে হয় না। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভিডিও যদি আপনার পছন্দ না হয়, যদি আনন্দ না পান তাহলে স্ক্রল করে পরের ভিডিওতে যাবার অপশনতো আছেই। সেটা ভালো না লাগলে তার পরের ভিডিও বা তারপরেরটা, তারপরেরটা। এভাবে ইনফাইনাইটের স্টাইলের স্ক্রলের ব্যবস্থা করা আছে। খুব সুচারু ভাবে সুকৌশলে একটার পর একটা ভিডিও আসতেই থাকবে আপনার সামনে। কনটেন্টের কোন শেষ নেই। আবার সব কনটেন্ট কিন্তু আপনার ভালো লাগবে না। এটাও একটা কারসাজি।
সবই যদি ভালো লাগে তাহলে পছন্দের কন্টেন্ট খোঁজার আনন্দটা থাকে কিভাবে? কিছুটা জুয়া খেলার মতো অবস্থা। আপনার জেতার সুযোগ আছে ঠিকই তবে সব সময় আপনি জিতবেন না। এজন্যই কিন্তু জুয়া মানুষকে এতটা আকৃষ্ট করে।
যে ভাবে ডোপামিন ক্ষরণ এর আশায় পছন্দের কন্টেন্ট খুঁজতে আপনার চোখ স্ক্রিনের সাথে লেগে থাকে আঠার মতো। আর For You পেজ তো অনেকটাই আপনার ইন্টারেস্ট উপর নির্ভর করে কাস্টমাইজ করা। আপনি কোন কোন ভিডিও দেখতে পছন্দ করেন তা আগে থেকেই জানে টিকটক। সে অনুযায়ী ভিডিও দেখাবে আপনাকে।
কী ঘটকা লাগছে? আপনার কি পছন্দ তা টিকটক কীভাবে জানে? টেক বিজনেস ওয়ার্ল্ডে একটা কথা প্রচলিত আছে, IF YOU DON'T PAY FOR THE PRODUCT, YOU ARE THE PRODUCT। টিকটক অ্যাপটি আপনার হাতের ফোনটিতে ইন্সটল করতে কত টাকা খরচ হয়? এক পয়সাও না তাই না? একেবারে ফ্রি তে পাওয়া যায় এই ডোপামিন প্রোডিউসার। টিকটকের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ByteDance Limited এর লাভ কী? তাহলে এত কষ্ট করে বানানো একটা প্ল্যাটফর্ম বেমালুম ফ্রিতে কেন দিচ্ছেন তাঁরা? নিজের কাছে প্রশ্ন করে দেখেছেন কখনও? আর টিকটকের Terms and Policies সেটাতে চোখ বোলানোর ফুরসত মিলেছে কি?
মোটামুটি আমরা সবাই জানি আমাদের ফোনে যে সব অ্যাপ আমরা ব্যবহার করি সেগুলোকে আমাদের ফোনে বিভিন্ন ডেটার অ্যাকসেস দিতে হয় বিভিন্ন প্রয়োজনে। টিকটক এর ব্যতিক্রম নয়। তবে টিকটক আপনার ফোন থেকে যে সব ডেটা কালেক্ট করে তার মধ্যে কিছু কিছু বেশি ইন্টারেস্টিং। আপনার ফোনের গ্যালারি, মেসেজ, অন্যান্য বিভিন্ন অ্যাপের ডেটা, আপনার ব্রাউজকৃত সাইটের ডেটা, লোকেশন সহ আরও নানা রকম ডেটা সংগ্রহ করে টিকটক। মোট কথা, আপনার ফোন দিয়ে আপনি কখন কী করছেন তার প্রায় সবটাই টিকটক কর্তৃপক্ষের কাছে চলে যায় একেবারেই আপনার অজ্ঞাতসারে। সেসব ডেটা অ্যানালিসিস করে আপনার পছন্দ অপছন্দ প্রেডিক্ট করা হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে।
এবার বুঝতে পারছেন টিকটক For You পেজ আপনার পছন্দের ভিডিও দিয়ে সাজাই কীভাবে? এবার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। আপনার প্রাইভেসি বলে কিছু থাকছে কি আদৌ? আপনি কি চান আপনার গ্যালারির ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ছবি বা আপনার মেসেজ, ব্রাউজার হিস্টোরি অপরিচিত কারও হাতে চলে যাক আপনার অজান্তেই? প্রশ্ন হল ByteDance Limited এসব দিয়ে কী করে? এটাই তো?
ইতিমধ্যেই বুঝেছেন টিকটক অ্যাপ ইউজারের পছন্দ অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করা, যাতে ইউজাররা আরও বেশি সময় ধরে টিকটক এ সময় কাটায়। তবে এটা বাদেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে আর সেগুলির কোনোটার থেকে কোনোটা চমকে ওঠার মতো। ২০২৩ সালের মধ্যে চীন চাই বিশ্বের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের লিডার হতে। কিন্তু কেন চায়? সামনে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের পুরোটাই হয়ে পড়বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর। সে তো জানা কথা। মূলত মানুষের পার্সোনালটাকে কুক্ষিগত করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে World Domination চালানোর পাঁয়তারা করছে চীন। হ্যাঁ, ভুল কিছু শোনেননি।
চীনা কমিউনিস্ট সরকার নিজেদের নাগরিকদের কব্জায় রাখতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে আসছে আরও আগে থেকে। তাঁদের পরবর্তী লক্ষ্য আপনাকে আমাকে কব্জায় আনা। আর সেই লক্ষ্য অর্জনে তাঁদের সাইকোলজিক্যাল অস্ত্র এই টিকটক। চাইনিজ'ল অনুযায়ী ByteDanceLimited চাইনিজ কমিউনিস্ট সরকারকে তাদের সংগৃহীত সকল ডেটা দিতে বাধ্য। যদিও তারা এটা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। সেটাই তো স্বাভাবিক। এসকল দিক বিবেচনা করেই হয়তো Reddit এর সিইও Steve Huffman টিকটককে ফান্ডামেন্টাল প্যারাসিটিক বলে অভিহিত করেছে।
শুরুতে বলেছিলাম টিকটক ভিডিও দেখলে ডোপামিন ক্ষরণ হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ডোপামিন খারাপ কিছু? না, ডোপামিন খারাপ কিছু নয়। কিন্তু সবসময় ডোপামিন ক্ষরণ মোটেও ভালো কিছু নয়। এতে করে আমাদের মস্তিষ্কের গঠনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। মস্তিষ্ক ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকে। কমতে থাকে চিন্তাভাবনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। হ্রাস পেতে থাকে সৃজনশীলতা। সেই সাথে ধৈর্য আর মনোযোগ কমতে থাকে আশঙ্কাজনক হারে। টানা কয়েকটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের বাহারি টিকটক ভিডিও দেখার পর একটা বই খুলে বসুন তো। দেখুন তো মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন কিনা? এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৭ ভাগ ইউজার random স্ক্রল করা অবস্থায় কোনো একটা ভিডিও দেখার ৩০ সেকেন্ড পরে ভুলে যান কী দেখেছিলেন। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা বুঝতে পারছেন? মেমোরীর অবস্থা দিনদিন হয়ে যাচ্ছে গোল্ডফিশের মতো।
টিকটক ইউজারদের বেশির ভাগই উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ে। তাদের বাড়ন্ত মস্তিষ্কে টিকটক এর ক্ষতিকর প্রভাব আরও বেশি। এদের অনেকেই টিকটক কনটেন্ট দেখার ভয়াবহ নেশায় পরে টিকটককে নিজের জগৎ বানিয়ে ফেলছে। না হচ্ছে সুস্থ মানসিক বিকাশ, না হচ্ছে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা। টিকটকে ছড়ানো, নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য আর মিথ্যে গুজব সহজে বিশ্বাস করে। তা থেকে নানা বিপত্তি বাধে। অনেক সময় আবার অনেকে তথাকথিত টিকটক স্টারদের কে নিজের আইডল মানতে শুরু করে। তাঁদের মতো ড্রেস, হেয়ার স্টাইল দেখছেন না এসব? আর এগুলোতে আগামীতে ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
টিকটককে ঘিরে নানা সময়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক। বিশ্ব জুড়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ক্যাম্পেনে বিভিন্ন ভিডিও সরিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে বহুবার। এমনকি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বানানো কনটেন্টও কমিউনিটি রুলস এর অজুহাত দেখিয়ে সরিয়ে ফেলেছে টিকটক। এ সবের কারণ কী জানেন? টিকটক চায় আপনার সামনে চকচকে কনটেন্ট আসুক প্রতিনিয়ত। যাতে করে আপনি টিকটকে বেশি আকৃষ্ট হন। তাছাড়া খেয়াল করলে দেখবেন একটু বেশি রাত হলে টিকটকের সাজেশনের যৌন আবেদনময় কনটেন্টের ছড়াছড়ি। এটাও প্ল্যান মাফিক করা হয় উঠতি বয়সী তরুণদের আকৃষ্ট করতে। টিকটকে নির্যাতিত নিপীড়িত ফিলিস্তানবাসীদের পক্ষে কনটেন্ট বানিয়ে দেখুন। নিতান্তই চাঁদ কপাল না হলে আপনার অ্যাকাউন্ট হাওয়া হয়ে যাবে নিমেষে।
টিকটকের ভালো কোনও দিক দিয়ে একেবারেই নেই ব্যাপারটা এমন না। তবে যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তিই একটু মাথা খাটালেই বুঝতে পারবেন। এর সুদূরপ্রসারী নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট এর কাছে পজিটিভ দিকগুলো নিতান্তই তুচ্ছ। তাই টিকটকের ভয়াল ছোবল থেকে আমাদের সমাজকে বাঁচানোর এখনই সময়। আর তার জন্য শুধুমাত্র একটি জিনিস প্রয়োজন তা হলো সচেতনতা। অপেক্ষা করুন ৩য় পর্বের।
টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০৩
Report This Post
All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.