জীবনের কত অংশই আপনার?

জীবনের কত অংশই আপনার?

Background Music


ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার সাহেব, এক কালে চাকরি করেছেন দেশের এক প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চপদে। তবে চাকরি থেকে অবসর করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বয়স ষাটের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আনোয়ার সাহেব খুলে বসেছেন জীবনের হিসেব নিকেশের খাতা। সারাটা জীবন উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দু হাত ধরে কামাই করেছেন তিনি। কমতি নেই কোনও কিছুরই। কিন্তু তার পরেও হিসেবটা ঠিক মিলছে না। কী যেন একটা নেই! ঘাড় গুঁজে পরিশ্রম করে সারাটা জীবন কামাই করেছেন ঠিকই, কিন্তু নিজেকে দিতে পারেননি আলাদা কোন সময়। তাই এখন তার কাছে মনে হয় জীবনটা যেন ষোল আনাই বৃথা। শেষ বয়সে এসে আনোয়ার সাহেবের মতো হিসাব মেলাতে না পারা কিংবা নিজের জীবনের উপর বিতৃষ্ণা জন্মানো মানুষের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। প্রিয় পাঠক আজ আমরা আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব করবো। জানার চেষ্টা করব জীবনের ঠিক কতটুকু অংশ একান্তই আপনার। বোঝার চেষ্টা করব জীবনের হিসেবটা কেন সবসময় অনিশ্চিত।

Life Cycle

ধর্ম, বর্ণ, জাতি যেটাই হোক না কেন মানুষ হিসেবে জন্মালে মৃত্যু অবধারিত একথা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের আয়ু নিয়ে মানুষের জন্য জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। সবাই ব্যস্ত নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে। এতটাই ব্যস্ত যে একটা সময় হয়তো আমরা ভুলেই যাই, প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আয়ু থেকে একটু একটু করে খরচ করছি আমরা।

বলা হয়ে থাকে, আমাদের এই ইউনিভার্সের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। আর পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম স্পন্দন এর অস্তিত্ব মেলে ৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে। সে তুলনায় পৃথিবীতে আপনার আমার কাটানো সময়টা খুবই নগণ্য। তার পরেও একটা হিসেব কষা যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর। সময়টা কিন্তু নেহাতই কম নয়। তবে জানেন কি, এই সময়ে ঠিক কতটা অংশ একান্ত আপনার? কয়েকটা বছর আপনি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারবেন?

ধরা যাক আপনি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। যার কোনও স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। আপনার গড় আয়ু ৭০ বছর। আপনি যদি প্রতিদিন অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটান তাহলে আপনার জীবদ্দশার মোট ২৫ টা বছর শুধু ঘুমিয়ে কাটাবেন। বাকি থাকল ৪৫ বছর।

এবার আলোকিত মানুষ হতে হলে তো আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতেই হবে। আমরা মোটামুটি ৬ বছর থেকে স্কুল শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হই। এরপর উচ্চশিক্ষা বাদ দিলেও ২৪ কিংবা ২৫ বছর বয়সে গিয়ে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। তো সেক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের গড়ে ৮ ঘণ্টা অতিবাহিত করতে হয়। এরপর HomeWork, Tution সব মিলিয়ে পরে আমাদের জীবনের মোট সময়ের ৫ টা বছর আমরা লেখাপড়ার পিছনে ব্যয় করি। অবশিষ্ট রইল ৪০ বছর।

স্কুল, কলে্‌ ইউনিভার্সিটির বারান্দায় দৌড়ে, এত সময় আর অর্থ ব্যয় করে একটা সার্টিফিকেট নামক পাণ্ডুলিপি তো নিশ্চয়ই পাবেন। যার বদৌলতে একটা চাকরিও হবে। এবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আপনাকে ওভারটাইম বাদে ন্যূনতম ৮ ঘন্টা সময় দৈনিক চাকরির পেছনে ব্যয় করতে হবে। সপ্তাহে ৪০ থেকে ৪৮ ঘণ্টা আপনাকে অফিসেই কাটাতে হবে। মোটামুটি ৫৫ বছর বয়সে মানুষ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নেয়। তো এবার হিসাব দাঁড়ালো আপনি জীবনে মোটামুটি ৯০ হাজার ঘণ্টা বা ১০ টা বছর চাকরি করে পার করেছেন। এবার আপনার হাতে আয়ু রইল ৩০ বছর।

প্রতিদিন অফিসে যেতেও কিন্তু আমাদের নূন্যতম একটা সময় ব্যয় করতে হয়। ঢাকা শহরের জ্যাম এর সাথে তুলনা করলে আমাদের প্রতিদিন মোটামুটি ঘণ্টাখানেক সময় হাতে রেখেই অফিসের জন্য বেরোতে হয়। আবার অফিস থেকে ফেরার পথেও কিন্তু ওই একই অবস্থা। তো সেই হিসেবে আপনি আপনার জীবনের ২ টা বছর জ্যামে বসেই অথবা অফিস যেতে যেতে পার করেন। আপনার হাতে বাঁচার মতো অবশিষ্ট আছে ২৮ বছর।

জীবন ধারণের জন্য খাবার তো আপনাকে খেতেই হবে। তিনবেলা খাবারের জন্য আপনাকে ন্যূনতম ৭০-৮০ মিনিট ব্যয় করতে হয়। মোট হিসেব করলে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ঘণ্টা। অর্থাৎ শুধু খাওয়ার জন্যই আপনি জীবনের ৪ বছর ব্যয় করেন। তো এখন আপনার কাছে আয়ু আছে ২৪ বছর।

এবার খাওয়া শেষে নিশ্চয়ই কিছু সাফসাফাই এর কাজ থাকে। তাছাড়া ঘর পরিষ্কার, জামাকাপড় ধোয়া-মোছা, টয়লেট কিংবা গোসলের মতো বিভিন্ন কাজে করে জীবনের আরও ৪ টা বছর ব্যয় করি আমরা।তো এখন আপনার কাছে আয়ু আছে ২০ বছর।

মোবাইল ফোন ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারেন কি? একদমই না! এই মোবাইলের পেছনে আমরা প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টা সময় খরচ করি। অর্থাৎ গড়ে জীবন থেকে ১৫ বছর এই মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। তো এখন আয়ু আছে ৫ বছর।

যাক হয়তো সব কিছু বাদ দিয়ে এবার ৫ বছর নিজের মতো করে বাঁচবেন। তাই তো? ধরে নিলাম ৫৫ তে অবসর নিবেন। এবং তারপর ভালোভাবে জীবনযাপন করবেন। যদি শরীরে কুলায় তো! অবসর নেওয়ার পর যে ১৫ বছর আপনার হাতে অবশিষ্ট থাকে, সে সময়তার অধিকাংশই আপনাকে গ্রাস করে রাখবে ডায়াবেটিস, হার্টের রোগের মতো নানা জটিল সব বার্ধক্যজনিত রোগ। বাকি জীবনটা কেটে যাবে ওই হাসপাতালের বারান্দাতেই।

Life Cycle

তাহলে আপনার হাতে আর সময়টা কই? আসুন এবার একটু ভিন্ন এক হিসাব কষি।

১ থেকে ১৮ বছরের কথাই ধরুন। যখন স্কুলে পরতেন বাবা মায়ের কাছেই ছিলেন প্রতিদিন। স্কুল শেষ করতে করতে আপনার বাবা মায়ের বয়স ৪০। অর্থাৎ তাদের হাতে আর ৩০ বছর সময় আছে। এই ৩০ বছরে আপনার জীবনে আসবে আমূল পরিবর্তন। প্রিয় মানুষ, পড়াশোনা, চাকরি সহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কিছুই। এ বয়সে অধিকাংশ মানুষই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমায়, পড়াশোনা কিংবা চাকরির উদ্দেশ্যে।

যদি আপনি ওই সময়টাতে বাড়ি ছাড়েন তাহলে বাবা মাকে দেখতে পাবেন কতদিন পরপর?

ধরলাম মাসে ৩ দিন অর্থাৎ বছরে ৩৬ দিন। তো যারা আপনাকে এই পৃথিবীতে এনেছে তাদেরকে আর ১০৮০ দিন দেখতে পাবেন। যেখানে আপনি আগে প্রতিদিনই তাদের দেখতে পেতেন। অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সের মধ্যে আপনার বাবা মায়ের সঙ্গে আপনি ৮৫ ভাগ সময় কাটিয়ে ফেলেছেন। এখন কেবলমাত্র আপনার কাছে ১৫% সময় অবশিষ্ট আছে।

হিসেবটা কেমন ভয়ঙ্কর রকমের অদ্ভুত। তাই না? প্রিয় পাঠক, আমাদের উদ্দেশ্য কোনও ভাবেই আপনাকে ডিমোটিভেট করা নয়। একটুখানি বোঝাতে চেয়েছি যে জীবন নিয়ে আমাদের কল্পনা পরিকল্পনার শেষ নেই , তা আসলে অনেকটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। জীবনটা হয়ত খুব ছোট মনে হচ্ছে। কিন্তু হলফ করে বলছি সঠিক নিয়মে বাঁচলেই সময়টাকেও আপনার কাছে অফুরন্ত মনে হবে। আপনি কিংবা আমি যেই হই না কেন, সময় আমাদের কারও জন্যই থেমে থাকে না। তাই সময়ের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে হবে। খাওয়া ঘুম, লেখাপড়া এই সময়গুলো আপনি চাইলেও বাদ দিতে পারবেন না।

তবে মোবাইল ফোনের পেছনে ব্যয় করা সময়ের কথাই ধরুন। এই সময়টাতে যদি প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটা নতুন স্কিল শেখার পেছনে ব্যয় করেন তাহলে বিষয়টা কেমন হয়?

এক সমীকরণে দেখা গিয়েছে, পৃথিবীর প্রায় ৬৮% মানুষ তাদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। অর্থাৎ একবার যদি নিজের চাকরির উপর আপনার অরুচি কাজ করা শুরু করে, তাহলে জীবনের ১০ টা বছর আপনার কাটবে নিরানন্দে। অপেক্ষায় থাকবেন কবে ছুটি আসবে। নিজেকে একটু সময় দেবেন। তবে মানসিক চাপের মাঝে কখন যে ছুটি আসবে, আর কখন যে চলে যাবে তা আপনি নিজেও টের পাবেন না। তাই এমন একটা চাকরি বেছে নিন যেটাকে আপনি ভালবেসে হাসিখুশি মনে করতে পারবেন। যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চাকরি করতে হয় তবে চাকরির মাঝেই ভালোলাগা তৈরি করুন।

যদি ভেবে থাকেন কর্মব্যস্ত জীবন শেষে অবসর নিয়ে নিজেকে একটু সময় দেবেন। সেগুড়ে বালি! বিশ্বের প্রায় ৭০% মানুষই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। স্কুলে পড়ার সময় স্যারের বকুনি আর পড়াশোনার চাপে পড়ে বলছেন না, কলেজে উঠেই ভালো একটা সময় কাটাবেন। এরপর কলেজে গিয়ে আবার হতাশায় ডুবে নিজেকে বুঝিয়েছেন চাকরি জীবনে গেলেই শান্তি। সেখানেও শান্তি না পেয়ে ভেবেছেন বিয়ে, বাচ্চা, সংসার অবসর আরও কত কী।

কিন্তু সে সুখ নামের মরীচিকা ধরা দিয়েছে কি?

তাই যখন যাই কিছু করুন না কেন, সেটা নিজের মতো করে করুন। সবকিছুর ভেতরে ভালো লাগা তৈরি করুন। একবার চিন্তা করুন আপনি আর মাত্র ৬ মাস বাঁচবেন। এখন আপনি কী করবেন?  নিশ্চয়ই আপনি আপনার তৃপ্তি সহকারে পছন্দের সব খাবার খাবেন। নিজের প্রিয় মানুষ, পরিবার নিয়ে একটা ভালো সময় কাটাবেন। পাপ কাজ থেকে দূরে থাকবেন। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেবেন।

তাই প্রতিটা দিন এমন ভাবে বাঁচুন যেন কোনও আক্ষেপ না থাকে। নিজের ভেতর থেকে সকল নেগেটিভিটি দূর করে সৃষ্টিকর্তার তরে নিজেকে সঁপে দিন। সময়ের মূল্য দিন, জীবন সুখের হবে। নতুবা সুখ নামের অধরা মরীচিকার পিছে ছুটতে ছুটতে কখন যে টুক করে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে পড়বেন, টেরই পাবেন না। জীবনের কতটুকু অংশ আপনার? জীবন শুরু হবার আগেই শেষ। তাই জেগে উঠুন।

জীবন অনেক ছোট


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.