কী ঘটেছিল ১২২১ সালে সিন্ধুতে?

কী ঘটেছিল ১২২১ সালে সিন্ধুতে?


চেঙ্গিস খান বুঝতে পেরেছিল, রণক্ষেত্রে তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো তার সমকক্ষ একজন ব্যক্তি আছে। আর সে হচ্ছে জালাল উদ্দিন। যেভাবেই হোক তাকে থামাতে হবে। এদিকে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কারণে সুলতান জালাল উদ্দিনকে রাজধানী ত্যাগ করতে হয়। অল্প কিছু অনুগত যোদ্ধা নিয়ে গজনিতে আসেন তিনি। কাবুলের উত্তরে পারওয়ান উপত্যকায় চেঙ্গিস খানের পাঠানো মঙ্গোলের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে যুদ্ধে জালাল উদ্দিনের দক্ষ সমন্বিততে অপরাজিত দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী তাদের প্রথম বড় পরাজয় তিক্ততা পায়। এর পরে জালাল উদ্দিনকে থামাতে না পারলে যে কী ঘটবে চেঙ্গিস খান তা ভালোই আচ করেছিল। এই ব্লগটি ১২২১ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিস খান ও জালাল উদ্দিনের বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত সিন্ধু যুদ্ধ নিয়ে।

চেঙ্গিস খান
চেঙ্গিস খান

মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে পারওয়ান উপত্যকার বিজয়টি যেমন নতুন করে আশা জাগিয়েছিল, ঠিক তেমনই নিরাশারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ মাল ভাগাভাগি নিয়ে ঘটে একটি অঘটন। দুজনের মধ্যে একটি আরবীয় ঘোড়া নিয়ে ঝগড়া লেগে যায়। এই দুজন ছিল সুলতান জালাল উদ্দিনের দুই সেনাপতি আবান মালিক ও সাইফ উদ্দিনের কমান্ডার। শেষে এই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল সেনাপতি আবান মালিক ও সাইফ উদ্দিন। এমন ক্রান্তিলগ্নে যেখানে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই এর পরিকল্পনা হওয়ার কথা ছিল, সেখানে সামান্য এক আরবিও ঘোড়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল।

জালাল উদ্দিন তাদেরকে শান্ত করতে ব্যর্থ হন। অহংকারের বশে অর্ধেক সৈন্য নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় সেনাপতি সাইফ উদ্দিন। যুদ্ধ জয়ের পরপরই ভেঙে গেল জালাল উদ্দিনের বাহিনী। সৈন্য সংগ্রহ করে নতুন সেনা বাহিনী গড়তে হলে সময়ের প্রয়োজন। তাই তিনি পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন। দিল্লি সালতানাতে গিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করবেন। এদিকে পরাজয়ের খবর পেয়ে চেঙ্গিস খান তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। এমন এক তরুণ যার রাজ্য দখল হয়ে গিয়েছে। যার সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী তাকে সমর্থন দেয়নি। নিজের গড়া সেনাবাহিনীও ভেঙে গিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় স্বয়ং চেঙ্গিস খান নিজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাও তার গোটা মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে। এটাই প্রমাণ করে যে চেঙ্গিস খান জালাল উদ্দিনকে কতটা ভয় পেত। কতটা হুমকি মনে করত তার সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য।

চেঙ্গিস খান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কোনো ভাবেই সে জালাল উদ্দিনকে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেবে না। সুলতান তার বাহিনী নিয়ে পার্বণ থেকে সিন্ধুতে পৌঁছলেন। সিন্ধু পাড়ি দিয়ে দিল্লি যাবেন। কিন্তু সেখানে ঘটেছিল আর এক বিপত্তি। খরস্রোতা সিন্ধু নদী পার হওয়া যাচ্ছিল না। নদীর তীব্র স্রোতে নৌকা উল্টে দিচ্ছিল। এ ভাবে ২ দিন সময় নষ্ট হয়ে যায়। এরই মধ্যে হঠাৎ ২ লাখ সৈন্য নিয়ে সিন্ধুপারের চলে আসে চেঙ্গিস খান। অন্যদিকে জালাল উদ্দিনের সৈন্যসংখ্যা মঙ্গোলদের চার ভাগের এক ভাগ।

দুইপাশে পাহাড় পিছনে খরস্রোতা নদী আর সামনে শত্রু, যারা এতদিন শহরের পর শহর দুলুর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। সেনাপতি সাইফ উদ্দিনের তার সৈন্যদের নিয়ে চলে যাওয়াতে জালাল উদ্দিনের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ না করে দিল্লিতে গিয়ে সৈন্য বাড়ানো। কিন্তু চেঙ্গিস খানের লক্ষ্য ছিল জালালকে সিন্ধুতীরে থামিয়ে দেওয়া। তা না পারলে যে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে মরণ কামড় দেবে চেঙ্গিস খানেরই ঘাড়ে। রণক্ষেত্র সংকীর্ণ হওয়ায় কিছুটা জালাল উদ্দিনের অনুকূলেই ছিল। কিন্তু মঙ্গোলদের হঠাৎ আক্রমণে কোনও পরিকল্পনাই তৈরি সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধের আগে চেঙ্গিস খান একটি ঘোষণা দিয়েছিল জালাল উদ্দিনকে কেউ যাতে হত্যা না করে, তাকে জীবিত ধরে আনতে হবে। শুরু হয়ে গেল চূড়ান্ত লড়াই। সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চেঙ্গিস খানের এটাই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। দুই সেনাপতি আবান মালিক ও তৈমুর মালিক কে দুইপাশে দিয়ে মাঝখানে অবস্থান নিয়েছিল জালালউদ্দিনে। সেদিন জালাল উদ্দিনের বাহিনী চূড়ান্ত আক্রমণে চুরমার হয়ে গিয়েছিল মঙ্গোল বাহিনীর অগ্রবাদ। ফলে মঙ্গোলরা পিছিয়ে যেতে শুরু করে। এমনকি চেঙ্গিস খান ভয়ে পিছিয়ে যায়।

সিন্ধু যুদ্ধ

তবে তার কাছে একটি ভিন্ন কৌশল ছিল। তার রিজার্ভ ফোর্সকে পাঠিয়ে দিয়েছিল পাহাড়ের উপর দিয়ে আচমকা জালাল উদ্দিনের বাহিনীর উপর আক্রমণের জন্য। জালাল উদ্দিন যখন চেঙ্গিস খানের মূল বাহিনীকে ধাওয়া করছিল, ঠিক তখনই পাহাড় ডিঙিয়ে সেনাপতি আবান মালিকের বাহিনীর উপর আক্রমন করে মঙ্গোল বাহিনী। অনাকাঙ্খিত আক্রমনে তীর বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরেছিলেন সেনাপতি আবান মালিক। বাহিনীর একপাশ ধ্বংশ হয়ে যায়। এ সুযোগে জালাল উদ্দীনকে ঘিরে ফেলে মঙ্গোল বাহিনী। এবার পুরো শক্তি দিয়ে আক্রমন করে চেঙ্গিস খান। মঙ্গোলদের বাহিনী থেকে জালাল উদ্দীন মাত্র ২৭ জন যুদ্ধা নিয়ে জীবিত বেরিয়ে এসেছিলেন। পথে ফেলে আসে মঙ্গোল সৈন্যদের লাশের স্তুপ। 

তার সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। নিরুপায় দেখে পিছনের ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ে অনেক উচুতে উঠে যান তিনি। সেখান থেকে ঘোড়াসহ নদীতে লাফিয়ে পড়লেন সুলতান জালাল উদ্দীন। লাফানোর সময় খাপ থেকে তলোয়ার বের করে চেঙ্গিস খানকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আবারো এসে যুদ্ধ করবেন। সেদিন যুদ্ধ শেষে চেঙ্গিস খান বলেছিলেন, "একজন বাবার এমনই ছেলে ছেলে হওয়া উচিত"।