এক রাতে ৯০০ মানুষ আত্মহতা করেছিল!

এক রাতে ৯০০ মানুষ আত্মহতা করেছিল!


দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করতেন ৭৬ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। নাম হিয়াসিন্থ থ্র্যাশ। ১৮ নভেম্বর ১৯৭৮,  ওইদিন রাতে হঠাৎ তীব্র সাইরেনের আওয়াজ পান তিনি। সেই সাথে মেগাফোনে ভেসে আসে এক গগনবিদারী ঘোষণা। এ ঘোষণা তো থ্র্যাশের জানা, এর আগেও বহুবার এমন ঘটনা শুনেছেন তিনি। সে মোতাবেক কাজও করেছেন। তবে এবার তিনি ঘর থেকে নড়লেন না। খাটের নীচে লুকিয়ে পড়লেন। তার এই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত যে কতখানি সঠিক ছিল তা তিনি বুঝতে পারেন পরদিন, যখন তিনি দেখতে পান তার আশেপাশের এলাকা জনশূন্য। কোথাও প্রাণের তেমন কোনও স্পন্দন নেই।

কী ঘটেছিল সেদিন রাতে? হোয়াইট নাইটের মানেই বা কী আর এক রাতে একটা এলাকা জনশূন্য হয়ে গেল কী ভাবে? 

সেদিন রাতে গান আর ওই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যা ঘটেছিল তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মত ব্যাপার। তখন পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসের সব চাইতে ভয়ানক গণ মৃত্যু ঘটে ওই রাতে। ৯০০ এর অধিক লোক একযোগে আত্মহত্যা করে সে দিন। যাদের এক তৃতীয়াংশই ছিল শিশু। আর তাদের সবাই স্বেচ্ছাইয় আত্মহত্যা করেছিল এমনও নয়।

কিন্তু কেন আত্মহত্যা? কী এমন ঘটেছিল? যার জন্য এত মানুষকে একসাথে প্রাণ দিতে হল!

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের যেতে হবে এক বিশেষ ব্যক্তির কাছে। তার নাম জিম জোন্স। ওই দিন রাতে মেগাফোনে যার গলার আওয়াজ ভেসে এসেছিল, এই সেই ব্যক্তি। জোন্সের জন্ম ১৯৩১ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা প্রদেশে। তার বাবা ছিলেন ১২ মাস শয্যাশায়ী এক যুদ্ধাহত ব্যক্তি। ফলে সংসারের হাল ছিল তার মায়ের কাছে। সারাদিনই বাইরে থাকতে হত তাকে। আর জোন্সের বাবা প্রায়ই থাকতেন হাসপাতালে। ফলে ছেলেবেলায় বাবা মায়ের আদর-সোহাগ খুব একটা জোটেনি জোন্সের। এই বয়সে গির্জার দিকে বিশেষ ঝোঁক ছিল জোন্সের। প্রায় বাইবেল বগলদাবা করে ঘুরত সে। একটু বয়স বাড়লে সে ধীরে ধীরে কমিউনিজমের ভক্ত হয়ে ওঠে।

জিম জোন্স
জিম জোন্স

বাটলার ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর ৫০ ও ৬০ এর দশক জুড়ে নামজাদা চার্চম্যান বনে যায় সে। অলৌকিক ক্ষমতাবলে যে কোনও রোগ সারানো কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী করা, এসব কাজের জন্য বেশ নামডাক হয়ে পড়ে তার। ১৯৫৫ সালে সে প্রতিষ্ঠা করে এক গির্জা। নাম উইংস অফ ডেলিভারি। যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় পিপলস টেম্পল নামে। এই গির্জার মাধ্যমে কমিউনিজ়মের প্রচার ও প্রসার ছিল তার উদ্দেশ্য। তৎকালীন সময়ে আমেরিকার বর্ণবাদ ছিল বেশ প্রকট। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল নিগৃহীত। জোন্সের কমিউনিস্ট আদর্শে নেই কোন ভেদাভেদ। সবার অধিকার সমান। ফলে অনেক নিগৃহীত নিপীড়িত আমেরিকানদের ভরসার স্থান হয়ে ওঠে পিপলস টেম্পল। পরবর্তীতে গির্জা ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থানান্তরিত করা হয়হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় সান ফ্রান্সিস্কোতে

এখানে আসার পর জিম জোন্সের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। প্রথাগত ক্রিশ্চিয়ানিটির বিরুদ্ধে সমালোচনা আর কমিউনিজমের প্রচারের ফলে ভক্তের সংখ্যাও বাড়তে থাকে তার। সেই সাথে বাড়তে থাকে দম্ভ ও অহংকার। ইতোমধ্যে বিভিন্ন খবরের কাগজে আসতে থাকে, জোন্স তার অনুসারীদের ভুলিয়েভালিয়ে তাদের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। সেই সাথে তার নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির খবরও ছাপা হতে থাকে পত্রিকাগুলোতে। আর খবরগুলো খুব একটা মিথ্যেও নয়।

People Temple
People Temple

তো যাই হোক। তনক নড়ে জোন্সের। সে বুঝতে পারে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আর পোষাবে না। ১৯৭৪ সালে সে আমেরিকা ছেড়ে উড়াল দেয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশ গায়ানায়। সেখানে কৃষিভিত্তিক এক কমিউনিস্ট সমাজ স্থাপিত হবে। কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই শান্তিতে বাস করবে। জোন্সের এসব মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে তার হাজারো অনুসারী তার সাথে পাড়ি জমায় গায়ানায়। যাদের বেশিরভাগই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু জোন্সের মতলব ছিল আলাদা। তার উদ্দেশ্য ছিল এমন এক জায়গায় গিয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে মার্কিন প্রশাসন তার টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। নিজের ইচ্ছামত তার অনুসারীদের চালানোই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। গায়ানা সরকারকে ঘোল আর ঘোষ দুটোই একসাথে গিলিয়ে জোন্স প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনবসতি স্থাপন আর সেখানে অবাধে পণ্য আনা নেওয়ার অনুমতি বাগিয়ে ফেলে। এই জনবসতি পরবর্তীতে পরিচিতি পায় জোন্সটাউন নামে।

জোন্সটাউন
জোন্সটাউন

আগেই বলেছি জোন্সটাউনের ঘোড়া ছিল সমানাধিকার শান্তি। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। ওখানে যাওয়ার পরে জোন্স তার অনুসারীদের একপ্রকার কয়েদি বানিয়ে ফেলে। তার হুকুমের বাইরে কিছুই করবার জো নেয়। সে যা বলে সেটাই চলে। রেডিও, টিভি সব কিছু চলত তার কথা মতো। খানিকটা বর্তমান সময়ে কিম জং উনের মতো কায়দা। অনুসারীদের সবার পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যাতে কেউ আমেরিকায় পালিয়ে যেতে না পারে। এখানেই শেষ নয়। লোকদেরকে জোরপূর্বক বিভিন্ন অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়। যার প্রায় সবই ছিল মিথ্যা। এ সব মিথ্যা স্বীকারোক্তিকে পুঁজি করে জোন্স তার অনুসারীদের ব্ল্যাকমেল করত, ভয় দেখাত। ওখানকার আদিবাসীদের আরও বলা হয়, তারা যদি এখান থেকে পালিয়ে যায় তাহলে মার্কিন সরকারের রোষানলে পড়বে তারা। তার উপর জনবসতি যে অঞ্চলে স্থাপিত হয়েছিল তা ছিল অনউর্বর। চাষাবাদ করে প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে খাদ্য সংকট ছিল সেখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সব মিলিয়ে জোন্সটাউনের আদিবাসীরা যেন এক দোজখ খানা এসে পড়ে।

বাচ্চাদের জন্য আলাদা সেকশন এর ব্যবস্থা করেছিল। সেই সেকশনে সব বাচ্চাদের দেখাশোনা করত তার স্ত্রী মার্সেলি। সারাদিনে মাত্র একবার বাচ্চাদের বাবা মায়েরা তাদের নাড়ি ছেঁড়া ধনের সাথে দেখা করার সুযোগ পেত। বাচ্চারা কোনও অপরাধ করলে তাদেরকে শুকনো কুয়োতে ভরে রাখা হতো। আর প্রাপ্তবয়স্কদের অপরাধের শাস্তি ছিল আরও ভয়াবহ। ছয় ফুট/চার ফুট/তিন ফুটের বক্সে বন্দী করে রাখা হত তাদের। অনুসারীদের কারও কাছে কোনও প্রকারের অস্ত্র বা গোলাবারুদ যেন না থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল জোন্সের। মোদ্দা কথা যত উপায়ে নিজের খবরদারি বজায় রাখা যায় তার কোনও কিছুই বাদ দেননি সে।

জোন্সটাউন

জোন্স তার অনুসারীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সরকার যে কোনও মুহূর্তে জোন্সটাউনে আক্রমণ করতে পারে। সেজন্য সবাইকে আগে থেকেই তৈরি থাকতে বলা হয়। কোনও আক্রমণ হলে হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নে ভয়ে পালিয়ে যাও অথবা বীরের মতো শত্রুর মোকাবেলা করো অথবা জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাও কিংবা একযোগে সবাই আত্মহত্যা করো। এই ছিল অনুসারীদের উদ্দেশে জোন্সের বক্তব্য। সে মোতাবেক প্রায় রাতেই এসবের অনুশীলন শুরু হয়। যেসব রাখতে ডাকা হত হোয়াইট নাইট নামে।

একজন স্বর্ণকারের এক ভুয়া লাইসেন্সের মাধ্যমে সায়ানাইডের এক বড় চালান নিজের আয়ত্তে এনে রাখে। যাতে তা গণহত্যার কাজে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এভাবে কতদিন? মার্কিন সরকার তো আর বসে নেই। তার অনুসারীদের অনেকের আত্মীয়স্বজন মার্কিন সরকারের কাছে ধর্না দেওয়া শুরু করে। কারণ জোন্সটাউনের আদিবাসীদের কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই সাথে মার্কিন সরকারের কানে আসে জোন্সটাউনে অনেক লোককে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

সায়ানাইড

সেখানকার পরিস্থিতি সরোজমিনে দেখতে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে লিও রায়ান নামে এক কংগ্রেস সদস্যকে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে আদিবাসীদের সাথে কথা বলার শুরুতে তার মনে হয় লোকেরা অনেক সুখে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই তার হাতে একটি চিরকুট এসে পড়ে। তাতে লেখা ছিল,

Help us! We want to get out of Jone's town.

 এই চিরকুট পাওয়ার পর তিনি আদিবাসীদের জানান, কেউ যদি তার সাথে আমেরিকায় ফেরত যেতে চায় তো যেতে পারে। শুরুতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ জন সম্মত হলেও, ক্রমেই আমেরিকায় ফেরত যেতে ইচ্ছুকদের দল ভারী হতে থাকে। জিম জোন্স বুঝতে পারে তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। রায়ানের বিমান উড্ডয়নকালে জোন্সের আদেশে তার এক বিশ্বস্ত শুটার গুলি চালিয়ে রায়ান সহ পাঁচজনকে হত্যা করে

জোন্সটাউনে আত্মহতা করার পরের ছবি
জোন্সটাউনে আত্মহতা করার পরের ছবি

আর ওই দিন রাতেই হোয়াইট নাইটের ঘোষণা দেওয়া হয়। জোন্স ভালো করেই বুঝেছিল মার্কিন সরকারের আক্রমণ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। রাতে সকল অনুসারীদেরকে জড়ো করে সুদীর্ঘ বক্তব্য দেয় সে। সকলকে বলা হয়, একযোগে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। কেউ কেউ তার কথায় একমত হলেও অনেকেই তা মানতে চায়নি। 

কিন্তু জোন্সের কথার বাইরে যাবে এমন সাধ্য কার?

প্রথমেই বিষাক্ত সায়ানাইড পান করানো হয় শিশুদের। এরপর পালাক্রমে প্রাপ্তবয়স্কদের। যারা স্বেচ্ছায় মরণ বিষ পান করতে চায়নি তাদেরকে জোর করে ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়। এক রাতেই ঝরে যায় ৯০০ এর অধিক তাজা প্রাণ। জোন্স নিজেও আত্মহত্যা করে। এভাবেই ক্ষমতালোভী নিষ্ঠুর সাইকোপ্যাথের খামখেয়ালিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গোটা এক জনপদ।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.