ইন্ডিয়া কিভাবে দেউলিয়া থেকে মুক্তি পেয়েছিলো?
প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া একটা দেশ ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি। ১৯৯১ সাল। ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরছিল ইন্ডিয়ার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। স্বাধীনতা পরবর্তী সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল দেশটি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল এক বিলিয়ন ডলারের নিচে। যা দিয়ে কেবল দু সপ্তাহের মতো আমদানি করা যাবে। সম্ভব হচ্ছিল না বৈদেশিক ঋণ মেটানো। বাধ্য হয়েছিল স্বর্ণ বন্ধক রেখে আরও ঋণ নিতে। আজকের এই ব্লগে ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক মন্দা সংঘটিত হওয়ার প্রধান কিছু কারন এবং কী ভাবে মন্দা ইন্ডিয়াকে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি তে পরিণত হতে সাহায্য করেছে সে ব্যাপারে জানব।
এই অর্থনৈতিক মন্দা সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেমন ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতিমালা দায় ছিল, ঠিক তেমনই এক্সটারনাল কিছু ফ্যাক্টরও সমভাবে দায়ী ছিল। স্বাধীনতার পরপরই ইন্ডিয়া সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনীতির পথে হাঁটে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগ ও ব্যবসার উপর জোর দেয়। পণ্য বা সেবার মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হতো। প্রাইভেট সেক্টর লাইসেন্স রাজের আওতায় কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হত। লাইসেন্স রাজ এর অধীনে প্রাইভেট সেক্টরে কোনও ব্যবসা শুরু করতে হলে কিংবা নতুন কোনও পণ্য উৎপাদন করতে হলে কখনো কখনো আশিটা প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। লাইসেন্স রাজের কারণে প্রাইভেট সেক্টর গতি ছিল অনেক কম।
স্বনির্ভরতার জন্য ইন্ডিয়া ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন মডেল যোগ দিয়েছিল। অর্থাৎ যেসব প্রোডাক্ট অন্য দেশ থেকে আমদানি করা প্রয়োজন, সেইসব প্রডাক্ট আমদানি না করে বরং নিজের উৎপাদন করবে। বিদেশি কোম্পানিগুলো ইন্ডিয়াতে তাদের বিজনেস শুরু করলে দেশীয় কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এই আশঙ্কায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল নিষিদ্ধ। এই অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা নীতির পরে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি, উদ্ভাবন আর প্রতিযোগিতার অভাবে উৎপাদনশীলতার ছিল অনেক কম এবং অদক্ষ।
অপরিশোধিত তেল এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল ছিল ইন্ডিয়া। রপ্তানির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পর পরই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হত সোভিয়েত ইউনিয়নে। কিন্তু ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। পুরো লেনদেনটি ছিল রুপি এবং রুবলে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরোটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পরে অতি প্রয়োজনীয় অপোরিশোধিত তেলের জন্য ইন্ডিয়াকে আরব দেশগুলো এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে যুক্ত হয়। আর সেখানেই প্রয়োজন হয় ডলারের।
১৯৯১ সালের শেষের দিকে শুরু হয় প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। যার ফলে তেল আমদানির জন্য ইন্ডিয়ার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়ে যেত। আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সবসময় বাণিজ্য ঘাটতি ছিল। মোট রফতানির ২২% রপ্তানি হত নিজস্ব মুদ্রায়। তা ছাড়া রুপির মান নির্ধারণ করত Reserve Bank of India। যার ফলে মেজর কারেন্সির বিপরীতে রুপির অতি মূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। আত্মনির্ভরশীল দেশ হওয়ার লক্ষ্যে দুইভাবে আমদানি কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল ইন্ডিয়া। প্রথমতো কী পরিমাণ আমদানি করা যাবে তা কোটা নির্ধারণ করে। অন্যটি ছিল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক বসিয়ে। এতে উন্নত প্রযুক্তি আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ব্যবসাগুলো প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ হয়।
সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ২০ টন স্বর্ণ বিক্রি করে এবং ৪৭ টন স্বর্ণ বন্ধক রেখে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছিল ইন্ডিয়া সরকার। IMF থেকে এমারজেন্সি লোন নিয়েছিল আরও প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। লোন এর জন্য IMF বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। সেসব শর্ত মানতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংস্কারে হাত দেয় ইন্ডিয়া। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ইন্ডিয়ার সরকার তিনটি পদক্ষেপ নেই। অর্থনৈতিক উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন। এর সংস্কার কার্যক্রম ইন্ডিয়া অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায় লাইসেন্স রাজ বাতিল এবং শিল্প ও বাণিজ্য নীতিতে ব্যাপক সংস্কার করা হয়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সকল বাধা তুলে নিয়ে প্রাইভেট খাতকে স্বতন্ত্রভাবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। রপ্তানি বাড়াতে মেজর কিছু কারেন্সি এর বিপরীতে রুপি ডিভিশন বা রুপির মান কমিয়ে ফেলা হয় প্রায় ২০%। ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। জাতীয় নিরাপত্তাজনিত খাত ব্যতীত সকল খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। নতুন ট্যাক্স দিতে ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। তুলে নেওয়া হয় বৈদেশিক বিনিয়োগের পথে সমস্ত বাধা।
পূর্বে গড়ে ওঠা অধ্যক্ষ শিল্পগুলো নতুন প্রযুক্তিতে পণ্য দক্ষতাই উৎপাদন শুরু করে। যেখানে আশঙ্কা করা হয়েছিল দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। অর্থনৈতিক সংস্কারের পরে বরং তার উল্টো চিত্র দেখা গিয়েছে। অনেক ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্লোবাল জায়ান্টে পরিণত হয়েছে। গড়ে উঠেছে প্রচুর স্টার্ট আপ। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে যেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯৭ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমানটা দাঁড়ায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থনৈতিক মন্দার ১৮ বছর পর ২০০৯ সালে ইন্ডিয়া IMF থেকে দুইশ টন স্বর্ণ ক্রয় করে। ২০২৩ সালের ফোর্বস ইন্ডিয়ার এক রিপোর্ট অনুসারে ইন্ডিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছয়শ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইন্ডিয়া বর্তমান বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। স্বাধীনতা পরবর্তী স্বনির্ভর চিন্তা ভাবনায় শিল্প উন্নয়ন হয়েছিল ব্যাপক। অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটাতে গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম তাদের অর্থনীতিকে করে তুলেছে আরও অপ্রতিরোধ্য।