অমীমাংসিত

অমীমাংসিত


২১শে ফেব্রুয়ারী, ২০০৬, রাত প্রায় ১.৩০। কোনো এক কলেজের আশেপাশে দূরে কোথাও মাইকে ভাঙা কণ্ঠে শহীদ দিবসের গান অনবরত বেজেই চলেছে। মাঝেমধ্যে ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়কে হর্ণ বাজিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে যাচ্ছে বাস অথবা ট্রাক। দূর থেকে আগত এসব শব্দ যেন এক ধরণের ছন্দ তুলে এই নিস্তব্ধ, ছায়াঘেরা, নিরাপদ প্রাঙ্গণে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এবারের শীতটা যেন একটু বেশীই জেঁকে ধরেছে। কলেজের কয়েকজন গার্ড শেডের তলায় খোশমেজাজে আগুন পোহাচ্ছে, মাঝেমধ্যে তাদের উচ্চস্বরে হাসির ক্ষীণ আওয়াজ পাচ্ছি চার বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ডে মাথাব্যথার এক অদ্ভূত সমস্যা নিয়ে ভর্তি একমাত্র ক্যাডেট আমি। ঘুম আসছে না, বেডে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি,তখন বাজছে “সালাম সালাম হাজার সালাম”, এই গানটি। হঠাৎ খেয়াল করলাম একাডেমিক ব্লকের দিক থেকে একটা ছায়া যেন এগিয়ে আসছে ওয়ার্ডের জানালার দিকে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেলো, এত রাতে তো কোন ক্যাডেট একা এখানে আসতেই পারবে না! কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই ছায়াটি ওয়ার্ডের জানালায় একটা টোকা দিয়ে আমারই এক বন্ধুর অবিকল কন্ঠে বলে উঠলো,”মাহমুদ, অনেক রাত হয়েছে,উঠে পড়”। বলেই যেন ছায়াটি কোথায় মিলিয়ে গেলো! ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ আমি “মামুন,এই মামুন” বলে ডাকলাম,কোন সাড়াশব্দ নাই। হতভম্ব আমি তখন ভাবছি যে বন্ধু আমাকে রাতে ঘুমাতে বলবে, উঠে আসতে বলবেই বা কেন!! তাড়াতাড়ি বেড থেকে উঠে সামনের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে কিছু না দেখতে পেয়ে দ্রত পিছনের দুইটা টয়লেটেরই জানালায় গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি কেউ নাই। হঠাৎ মনে হলো এটা জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা কোন জুনিয়রের কাজ। সাথে সাথে সিনিয়রের সাথে ফাইজলামির ফল দেখানোর উদ্দেশ্যে বের হয়ে গিয়ে দেখি জেনারেল ওয়ার্ডে বাইরে থেকে তালা মারা। ক্লাস টুয়েলভের একজন ভদ্র ক্যাডেট হওয়ার কারণে আমাকে হয়তো বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়নি। যাই হোক,আমার জিদ চেপে গেলো,উদ্ধার করতেই হবে। আমি সেই ছোট্ট হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সূরা ইয়াসিন পড়তে পড়তে পিছনে মেহগনি গাছের জংগলে ঢুকে খুঁজতে লাগলাম সেই অশরীরিকে। নাহ,কেউ নাই! কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে পরে ফেরত চলে আসলাম, পাছে আবার কলেজ পালানোর চেষ্টার অপরাধে অভিযুক্ত না হই!!

সেই রাত আর ঘুমাতে পারিনি। পরের দিন মামুনকে ডেকে আনিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম যে সে রাতে এসেছিলো কিনা। মামুন বললো অত রাতে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো,সে আসেনি। আর অত রাতে এতগুলো গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাসপাতালে আসা এত সহজ ও ছিলো না সেই সময়! ক্যাডেট কলেজে ভর্তির প্রথম দিন থেকেই শুনেছি একাত্তরে এই কলেজ পাক আর্মির ক্যাম্প ছিলো, বহু মানুষ মেরে পুঁতে রেখেছে তারা যাদের আত্না নাকি মাঝেমধ্যে রাতের বেলায় কলেজে ঘুরে বেড়ায়, সব হাউজের ৩ নাম্বার বাথরুমে নাকি রাতের বেলা শাওয়ার দিয়ে রক্ত পড়ে! যদিও এগুলো সব চাপবাজি ছিলো। তবে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস না করলেও জীবনে ঘটে যাওয়া এই রহস্যের এখনো কোন সমাধান পাইনি….


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.