হোমিওপ্যাথি আসলে কতটা কার্যকর?

হোমিওপ্যাথি আসলে কতটা কার্যকর?


ছোটবেলায় জ্বর, সর্দিকাশি বা অ্যালার্জির মতো ছোটখাটো বিভিন্ন রোগের নিরাময়ের জন্য রাবারের ছিপি আঁটা স্বচ্ছ কাচের শিশিতে ভরা গোলাকার মিষ্টি চিনির দানা খাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া একটু কষ্টকর হবে। শত শত বছর ধরে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে অনেকেই গ্রহণ করে আসছেন এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা।

আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের দিনে দাঁড়িয়ে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার জৌলুসের কাছে খানিকটা বিবর্ণ হয়ে পড়লেও আজও কিছু মানুষ এই চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্ধ ভক্ত। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কি আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে?>এই চিকিৎসা ব্যবস্থা কী আসলে বিজ্ঞানসম্মত? এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব আজকের ব্লগে।

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কারক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। জার্মানির এই ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তখন বিশ্বাস করা হতো চার রকমের তরল, কালো ও হলুদ রক্ত আর কফের তারতম্যই হলো যত রোগের কারণ। এই অদ্ভুত তত্ত্ব অনুসারে অদ্ভুত সব চিকিৎসা করা হতো। হ্যানিম্যানের এই অবস্থা ভালো লাগেনি। তিনি চেয়েছিলেন ভালো কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি বের করতে। এই করতে গিয়ে তিনি একদিন সিনকোনা গাছের রস খেয়ে ফেললেন। এতে করে তার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো যা খানিকটা ম্যালেরিয়া রোগের উপসর্গের মতোই।

স্যামুয়েল হ্যানিম্যান
স্যামুয়েল হ্যানিম্যান

তখন তাঁর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে যা দিয়ে রোগের উৎপত্তি তা দিয়ে রোগ নিরাময় সম্ভব। তো তিনি সবাইকে সিনকোনা গাছের পাতার রস খাইয়ে দিলেন। দেখলেন সবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। এরপর তিনি রোগ সারানোর জন্য অতি অল্পমাত্রায় সিনকোনা গাছের পাতার রস খাইয়ে দিতে লাগলেন পানি অথবা অ্যালকোহলের সাথে দ্রবীভূত করে। কোত্থেকে যেন কিছু হাইপোথিসিসও বানিয়ে ফেললেন তিনি। যার কোনো ভিত্তি এখনও পাওয়া যায়নি।

Homeopathy

হোমিওপ্যাথির দুইটি মূল নীতি হচ্ছে একই ধরনের পদার্থের সূত্র এবং লঘুকরণ সূত্র।

একই ধরনের পদার্থের সূত্র অনুযায়ী,

যে পদার্থের উপস্থিতিতে একটি রোগের সূত্রপাত হয়েছে সেই পদার্থের খুব স্বল্প পরিমাণ সেবনে রোগ সেরে যাবে। 

লঘুকরণ সূত্র অনুযায়ী,

ওষুধের মাত্রা যত কম হবে তার প্রভাব তত বেশি হবে।

অথচ বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওষুধের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে তার প্রভাবও বাড়বে। প্রথম সূত্র, বিজ্ঞানসম্মত কোনো প্রমাণ নেই। হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা নিয়ে যুগে যুগে অনেক গবেষণা হয়েছে। যার অধিকাংশের ফলাফল হলো হোমিওপ্যাথিক কার্যকরী কোনো চিকিৎসা নয়। আর সেগুলোর ক্ষেত্রে কাজ করে সেগুলোকে প্লাসিবো ইফেক্ট বলে ধরে নেওয়া হয়।

এমনকি কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্লাসিবো ইফেক্ট এর চেয়েও বেশি। আজ থেকে বহু বছর আগে এক মজার পরীক্ষা করেন রবার্টস নামের এক বিজ্ঞানী। যা Nature পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় ১৯০৯ সালে। পরীক্ষাটা এরকম দুটি প্রচলিত কড়া হোমিওপ্যাথি ওষুধ নেওয়া হলো। একটি ন্যাট্রিয়াম মিউরিয়েটিকাম (৩০ সি) অন্যটি সালফার (৩০ সি) হোমিওপ্যাথ ডাক্তার দৃষ্টিতে দুটোই খুব জবরদস্ত ঔষধ।

দুইটি ওষুধকে যথারীতি দ্রবীভূত করা হলো। হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরির পদ্ধতি অনুসরণ করে পোটেন্সি বা ঔষধি গুণ বাড়ানোর জন্য যে ভাবে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বারবার দ্রবণ তৈরি করা হয়, তা করা হলো। এরপর একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে দুটি দ্রবণ দেওয়া হলো।

তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ক্লিনিক্যাল টেস্ট, যাবতীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করেও দুটি ওষুধকে আলাদা করে চিনতে পারলেন না। অর্থাৎ একটাকে আর একটার থেকে আলাদা করে কোনটা সালফার আর কোনটা ন্যাট্রিয়াম বুঝতে পারলেন না। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি যে দুটোই এক। কোনোটাতেই আর ওষুধের অনু মাত্রও নেই।

তাহলে কি আছে? কোন ঔষধটা কাজ করে শরীরের উপর?

Homeopathy

এক সময় মনে করা হতো জলে মেশানোর পর দ্রবণে মূল পদার্থ কণা কমতে কমতে যখন একটিও অণু থাকে না তখনও জলে তার স্মৃতিটুকু থাকে। আর এই স্মৃতি মারাত্মক রকম ক্ষমতা সম্পন্ন। কিন্তু না! এই থিওরিও নাকচ হয়ে গেছে।

২০০৫ এ নতুন একরকমের স্পেকট্রোস্কোপিক পদ্ধতির সাহায্যে দেখানো হয়েছে যে, স্মৃতি বা যেটুকু রেশ থাকে দ্রাবকে সেটিও মুছে যায় এক ফেমটো সেকেন্ডের মধ্যে। অর্থাৎ এক সেকেন্ডের অনেক কম সময়ে। কাজেই সেই মারাত্মক ক্ষমতাকে বোতলবন্দি করে রাখার কোনও প্রশ্নই উঠছে না।

হোমিওপ্যাথি অনুযায়ী সাইলেসিয়া ২০০ খেলে নাকি গলায় ফুটে থাকা মাছের কাঁটা গলে যায়। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ সাইলেসিয়া ২০০ ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষণে উদ্দেশ্যে কাচের প্লেটে সাইলেসিয়া ২০০ নিয়ে তাতে দিনের পর দিন মাছের একটি ছোট কাঁটা ডুবিয়ে রেখে দেখেন কাঁটা যেমন ঠিক তেমনই রয়ে গেছে

আর এসব ছাড়াও বিভিন্ন নামজাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কী বলছে দেখুন, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে হোমিওপ্যাথিক এ অকার্যকর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। রয়্যাল লন্ডন হসপিটাল ফর ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন ২০১৮ সালে এপ্রিল থেকে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে হোমিওপ্যাথি ওষুধের গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া প্রাইভেট হেল্থ ইনস্যুরেন্সের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী পহেলা এপ্রিল ২০১৯ থেকে ইন্স্যুরেন্স কভারেজের আওতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার থাকছে না। আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশন সাফ বলে দিয়েছে, হোমিওপ্যাথি ওষুধের গায়ে আন্তর্জাতিক লেবেল থাকতে হবে। উইকিপিডিয়ার অপবিজ্ঞান  এর যে তালিকা করা হয়েছে তাতে হোমিওপ্যাথি সহ বিদ্যমান। 

Homeopathy

কিন্তু এতশত প্রমাণ থাকার পরও দেখবেন কিছু মানুষ হোমিওপ্যাথির সাফাই গাইবে। তাদের প্রথম বলি এলোপ্যাথিক ডাক্তাররা নাকি ওষুধ কোম্পানির সাথে চুক্তি করে হোমিওপ্যাথিকে দাবিয়ে রাখে। যেহেতু হোমিও ওষুধের দাম কম আর অ্যালোপ্যাথি ওষুধের দাম বেশি। তাই এত কোম্পানি এবং ডাক্তার সবারই লাভ বেশি। এজন্যই বেচারা হোমিওপ্যাথি এলোপ্যাথি সাথে সুবিধা করে উঠতে পারছে না। আর হোমিওপ্যাথির তো কোনো সাইড এফেক্ট নেই।

তো দেখুন হোমিওপ্যাথির টোটকাগুলো মূলত প্ল্যাসিবো। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে এই টোটকাগুলো কোনো রোগ ছাড়াই না। যার কোনও ইফেক্টই নেই তার সাইড ইফেক্ট আসবে কোথা থেকে? 

অনেকে বলে হোমিও ঔষধ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি। হ্যা, কিছু কিছু হোমিও প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ঠিকই। কিন্তু তা এক বিষাক্ত মাকড়শা থেকে প্রস্তুত করা হয় মাল্টিপল স্কেরেসিস নামের এক মস্তিস্ক ও শিরদাড়া রোগের টোটকা। কোবরার বিষ থেকে তৈরি করা হয় ক্যান্সারের টোটকা। প্রাকৃতিক উপাদানের নামে আপনি এসব সেবন করতে প্রস্তুত তো?

Homeopathy

আর হোমিওপ্যাথের তেমন কোনো সর্বজনীন গৃহীত স্ট্যান্ডার্ড নেই। কোনো মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। তাই ভেষজ ও প্রাকৃতিক উপাদানের নামে আসলে কী দেওয়া হচ্ছে তা বলাই মুশকিল। অনেকের মুখে শুনে থাকবেন অমুকের রোগ সেরে গেছে বা আমার বেলায় কাজ করেছে। আসলে প্লাসিবো বা নকল ওষুধের ধর্মটাই এমন। মানুষের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক শক্তিশালী। তাই অনেক ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজেই রোগ সারিয়ে দিতে পারে। নকল ওষুধ শুধু ভরসাটুকু দেয় মাত্র।

কেউ কেউ বলবেন, এসব ওষুধ আমেরিকা থেকে তৈরি হয়। তারা তো ঠিকই ব্যবহার করে। তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, খোদ আমেরিকাতেই ভীষণ বাধার মুখে রয়েছে হোমিওপ্যাথি। শুধুমাত্র কিছু লোকের বিশাল ব্যবসা বন্ধ হবে বলে তারা জিইয়ে রেখেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। পেশাজীবী সন্দেহবাদী জেমস রেন্ডি প্রায়ই তাঁর পাবলিক বক্তব্যের আগে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেতেন। এমনও হয়েছে যে, বক্তব্য দেওয়ার আগে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এর ছয় মাসের কোর্স একেবারে গিলে ফেললেন তিনি। বক্তব্য শেষ করে বেরিয়ে গেলেন ঘুমালেন না।

জেমস রেনি

একবার তিনি কংগ্রেসে গেলেন। একই ওষুধ খেয়ে কাজ হলো না। শেষমেশ ব্যঙ্গাত্মকভাবে জানান,

কংগ্রেসের মিটিং আর হোমিওপ্যাথির ঘুমের ওষুধ মিলে আমাকে ঘুম পাড়াতে পারলো না। আমার মনে হয় কিছুই আমাকে ঘুম পাড়াতে পারবে না।

জেমস রেন্ডির একটা চ্যালেঞ্জ ছিল সুপারন্যাচারাল কিছু প্রমাণ করতে পারলে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার। সেটাতে তিনি হোমিওপ্যাথিকে সুযোগ দিয়েছিলেন। কয়েক জন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের বিদ্যার কার্যকারিতার প্রমাণ তারা করতে পারেনি। আর বড় বড় হোমিওপ্যাথরা অংশই নেননি। ভাবুন তো দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সন্দেহবাদের কাছে গিয়ে নিজেদের প্রমাণ দেওয়াটা কত বড় পাবলিসিটি হতে পারত তাদের জন্য। তারপরেও তারা গেলেন না কেন? অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন হোমিওপ্যাথিতে সমস্যা কি? কাউকে তো আর জোর করে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে না। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই।

হ্যাঁ, সবই মেনে নিলাম। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে ঔষধের নামে পানি বা অ্যালকোহল আর চিনির বড়ি খাইয়ে টাকা নেওয়াটা প্রতারনার শামিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্লাসিবো কাজ করে সত্যি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা করে না। আর যে ক্ষেত্রে তা করে না সে রোগীদের কষ্ট কমানোর জন্য ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও হোমিওপ্যাথি জোর জবরদস্তি চালানো তা নৈতিক ভাবে ভুল। হোমিওপ্যাথি এক অপবিজ্ঞান। এই আধুনিক যুগে এসেও এমন অপবিজ্ঞানের ফাদে পা দিয়ে নিজের ক্ষতি নিজেই ডেকে আনা আর যায় হোক কোনো সুবুদ্ধির পরিচয় নয়। 



Files


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.