হুমায়ুন আহমেদের "কোথাও কেউ নেই" উপন্যাস কেমন ছিল?

হুমায়ুন আহমেদের "কোথাও কেউ নেই" উপন্যাস কেমন ছিল?


কোথাও কেউ নেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে (BTV) প্রচারিত একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক নাটক। নাটকটির রচিয়তা কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর এবং পরিচালক ছিলেন বরকত উল্লাহ। একই নামে হুমায়ুন আহমেদের একটি উপন্যাসও রয়েছে। মূলত উপন্যাসের কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নাটকটি নির্মিত হয়। এর আবহ সংগীতের কাজ করেন সংগীতকার মকসুদ জামিল মিন্টু

নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনি

ধারাবাহিকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল "বাকের ভাই"। বাকের ভাই গুন্ডা প্রকৃতির লোক এবং তার সঙ্গী ছিল "বদি" আর "মজনু",।

তারা তিনজনই মোটরসাইকেলে করে চলাফেরা করতো। অধিকাংশ সময় মোটরসাইকেল চালাতো মজনু, বদি বসতো পিছনে, বাকের ভাই বসতো মাঝে। বাকের ভাইয়ের একটা অভ্যাস ছিল সে একটা চেইন হাতের তর্জনিতে অনবরত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচাতো, আবার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে আবার প্যাঁচাতো। সক্রিয় ডায়লগ না থাকলে প্রায়ই তাকে এরকম করতে দেখা যেত। বাকের ভাই 'মুনা'কে পছন্দ করতো।

মুনা এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সে চাকরি করে, এবং তার মামাতো ভাই-বোনদের দেখাশোনা করে। আর মামুন নামে এক বেকার যুবকের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল।

বাকের ভাই এলাকার মাস্তান হলেও অধিকাংশ মানুষ তাকে ভালোবাসতো, কারণ সে যেমন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পিছপা হতো না, তেমনি সমাজের অন্যায়কেও মুখ বুজে মেনে নিত না। নিজের লোকদের দিয়ে সে কঠোর হস্তে দমন করতো।

ঘটনাপ্রবাহে বাকের ভাই রেবেকা হক নামের এলাকার প্রভাবশালী এক নারীর সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। ঐ নারী তার বাড়িতে অবৈধ কার্যকলাপে করতেন। বাকের ভাই তা জানতে পেরে প্রতিবাদ করে। এই প্রভাবশালী নারী তার বাড়িতে কুকুর পালন করতেন বলে বাকের ভাই তাকে 'কুত্তাওয়ালী' বলেন। এরই মধ্যে রাতের অন্ধকারে 'কুত্তাওয়ালীর' দারোয়ান তার বাড়িতে খুন হয়।

ফাঁসানোর জন্য এই খুনের দায় দেয়া হয় বাকের ভাইকে, সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেয় 'কুত্তাওয়ালী'র সাজানো সাক্ষী এলাকার নব্য ছিনতাইকারী মতি। যদিও পদে পদে মতির মিথ্যা সাক্ষ্য বাকের ভাইয়ের উকিল ধরিয়ে দিচ্ছিলেন আদালতের কাছে।

কিন্তু এদিকে বাকের ভাইকে ফাঁসানোর জন্য কুত্তাওয়ালী লোভ দেখিয়ে বাকের ভাইয়েরই সাথী বদিকে হাত করে নেয়। বদি নিরুপায় হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বাকের ভাইকে ফাঁসিয়ে দেয়। আদালত ঐ খুনের দায়ে নির্দোষ বাকের ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

বাকের ভাইয়ের উকিল হিসেবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। আদালতের এই সিদ্ধান্তে যেন মরে যায় মুনার মন। এদিকে মুনার পরিবারের সবাইও বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি জমান। এই একাকিত্বের দিনে এক ভোরে আধো অন্ধকারে, চারদিকে যখন ফজরের আযান হচ্ছিল, জেল গেট দিয়ে বাকের ভাইয়ের লাশ বের করে দেয়া হয়। কেউ ছিল না সেই লাশ গ্রহণ করার জন্য মুনা ছাড়া।

সৎকার করার পর মুনা বড় একা হয়ে যায়। তার যেন আর কেউ রইলো না কোথাও। নাটকের নামকে সার্থক করে মুনা নাটকের শেষ দৃশ্যে ভোরের আলো অন্ধকারে ছায়া হয়ে একা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকে।

জনপ্রিয়তা

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শিত এই নাটক এতোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, নাটকটির প্রতিটা পর্ব দর্শকরা প্রবল আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করতেন। নাটকের পর্ব অগ্রগতির সাথে সাথে দর্শকরা বাকের ভাইকে পছন্দ করে ফেলেন এবং তার পক্ষে জনমত গড়ে উঠে। একপর্যায়ে যখন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে। উকিল হুমায়ূন ফরীদি শত চেষ্টাসত্ত্বেও যখন হেরে যাচ্ছেন এই মামলায়, তখন দর্শকরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। চলতে থাকে মিছিল, দেয়াল লিখন, সমাবেশ। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন মিছিল করে স্লোগান দিতে থাকে:

“ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালী জবাব চাই ”

কিংবা,

“ বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে। ”


এসকল খবর সমসাময়িক পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় বেশ গুরুত্বের সাথে। তখন স্বভাবতই মনে হয়েছিল হয়তো লেখক জনমতের ভিত্তিতে নাটকের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তা না করে নাটকের যথাযথ পরিণতি দেন, এবং বাকের ভাইয়ের পক্ষে দর্শকদের তুমুল আবেগ এবং সমর্থন সত্ত্বেও নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়।

নাটকটির তুমুল জনপ্রিয়তার ছায়া পড়ে বাকের ভাই চরিত্রের অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের জীবনেও। তিনি এর পর থেকে বাকের ভাই হিসেবে সমাদৃত হোন। এমনকি তিনি যেবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তখন তাকে বাকের ভাইয়ের নাম ধরেই নীলফামারীতে ভোট চাওয়া হয়েছিল।

এছাড়া নাটকটির আবহ সংগীত, দর্শক মহলে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায় এবং আলাদা করে ক্যাসেটে এর আবহ সংগীত বিক্রয় হয়।

দর্শক জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনায় নাটকটি বিটিভিতে পূণ:প্রচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে নাটকটির ক্যাসেট খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত এটি প্রচার করা যায়নি। ২০১৩ সালে বিটিভির মহাপরিচালক ম. হামিদের উদ্যোগে হারিয়ে যাওয়া সেই ইউম্যাটিক ক্যাসেট খুঁজে বের করে তা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা হয়। ৮ এপ্রিল সোমবার থেকে বিটিভিতে প্রচারিত হচ্ছে নব্বইয়ের দশকের এই জনপ্রিয় ধারাবাহিকটি।

বাকের ভাইয়ের ফিরে আসা

নাটকটির তুমুল জনপ্রিয়তায় অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাতা রেদোয়ান রনি নির্মাণ করেন সাত পর্বের একটি মিনি-নাটক। নাটকটির কাহিনী কোথাও কেউ নেই-এর পর থেকেই শুরু বলা যায়, এখানে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হিমু মুনাকে কথা দেয় সে বাকের ভাইকে খুঁজে বের করবে। ঘটনাপ্রবাহে একদিন সত্যি সত্যি বাকের ভাইয়ের সাথে দেখা হয় হিমুর। বাকের ভাই তখন তার সব কষ্ট উজাড় করে দেন। এই ধারাবাহিকে হিমু চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা মোশাররফ করিম ও মুনা ও বাকের ভাই চরিত্রে স্বভাবতই যথাক্রমে সুবর্ণা মুস্তাফা এবং আসাদুজ্জামান নূর। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ঈদুল ফিতরে ধারাবাহিকটি দেশ টিভিতে প্রচারিত হয়। 

কিছু চিত্র

কোথাও কেউ নেই

কোথাও কেউ নেই