রংধনু

রংধনু

Background Music


৬ মাসের বাচ্চা নিয়ে বাসরঘরে বসে আছি। অনেকে বলেছিল বাচ্চাকে মা চাচিদের দিয়ে দিতে। বাসর রাত বলে কথা৷ কিন্তু রাজি হয়নি। বাচ্চাটা একটু থেকে একটু হলেই কান্না করে দেয়। যে শান্ত করতে পারতো সে এখন আমার উপর সব দায়িত্ব দিয়ে কব*রে আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে৷ আমার এখনের স্বামীর নাম রবিন। ঘরোয়াভাবেই বিয়েটা হয়েছে আজ আমাদের। আত্মীয় স্বজন বেশি নেই। গোটা বিশেক লোক হবে এসেছে।

মাত্র আমার মেয়েটা ঘুমালো। একটু পরই রবিন এসে ঢুকলেন রুমে। দরজা মারলেন নিঃশব্দে। আমি পা দুটো আরো গুটিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে আরেকটু জোরে জাপটে ধরলাম। তিনি এসে বসলেন আমার কাছে। আমি মাথা নিচু করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। কতক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি বললেন, জানেন তো আমাদের দুজনেরই এটা দ্বিতীয় বিয়ে? আমি মাথা নাড়লাম। তিনি তাচ্ছি*ল্যের সুরে বললেন, কেন আমার স্ত্রী ছেড়ে গেছে এটা জানেন? আমি আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমাদের সাত বছরের প্রেম আর এক বছরের সংসার জীবন ছিল। কিন্তু আমাদের সবটা প্রেমই রয়ে গেল ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি। আমি তাকে মাতৃত্বের সুখ দিতে পারব না জেনেই ছেড়ে চলে গেল। আমি চুপ করে রইলাম।

- কি নাম ওর?

- মাইশা।

- বাহ্, অনেক সুন্দর নাম তো।

- ওর বাবার দেওয়া।

- দেখতেও কি বাবার মতো হয়েছে?

- হুম।

- আমার কোলে দেবেন একটু?

এবার আমি তার দিকে তাকালাম। মুখে আকুতিভরা, চোখ পানিতে ভরে উঠছে। দিলাম তাঁর হাতে। মেয়ে আমার যদিও জেগে গিয়েছিল কিন্তু কাঁদলো না। রবিন খেলল কতক্ষণ তার সাথে। আর মাইশা হাসছে। আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে আছি। তাকে মেহরাজ, আমার প্রাক্তন স্বামীর মতো লাগছে। খেলা শেষে ওকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বললেন, জানেন আমার মেয়ের খুব শখ ছিল। নুপুরকে বলতাম আমরা মেয়ে নেবো। কিন্তু বুঝতেই পারিনি সে ক্ষমতা আমার নেই। মাইশা না থাকলে হয়ত এ বিয়েটাও হতো না। কে জাইবে এমন ছেলের কাছে মেয়ে দিতে?

মাইশাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ঘুমিয়ে যান। সারাদিন খাটুনি গেছে অনেক। বলে মাইশার পাশে শুয়ে পড়লেন। আমি তখনো তাকিয়ে আছি। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। গভীর রাতে হঠাৎ অজানা অনিশ্চিত ভয়ে জেগে উঠলাম। পাশে ফিরে দেখলাম মাইশা ঠিক আছে কি না। রবিন একহাত দিয়ে রেখেছেন মাইশার উপর। যেন ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও ঘুমিয়ে গেছে। কি করে পরের মেয়েকে এত আপন করতে পারলেন!

সকালে চোখ খুলতেই দেখলাম মাইশা রবিন কেউই নেই। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে আশেপাশে তাকাতেই বারান্দায় চোখ পড়ল। রবিন রকিং চেয়ারে বসে ঘুম পাড়াতে চাইছে মাইশাকে। আমি কাছে যেতেই বললেন, কান্না করছিল, আপনার ঘুম ভেঙে যাবে দেখে এদিকে নিয়ে এসে ঘুম পাড়াতে চাইছিলাম। দুষ্ট বাচ্চাটা কিছুতেই ঘুমাতে চাইছে না। আমি দেখলাম মেয়ে হাত দিয়ে রবিনর দাড়ি নিয়ে খেলছে৷ আমি ফিক করে হেসে দিলাম। তিনি বললেন, হাসছেন যে বড়?

- মেয়ের আমার আপনার দাড়ি পছন্দ হয়েছে।

- তা হয়েছে। ভাবছি আরো বড়ো করব দাড়ি মেয়ে যাতে খেলতে পারে। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।

আমি মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে গেলাম। নাস্তা খেতে বসেছি। রবিন বললেন, আপনি বেলের আচার বানাতে পারেন? আমি বললাম, দেখেছিলাম। আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ি বানাতেন খুব ভালো। তার আচারের স্বাদই আলাদা ছিল। তিনি রুটিটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, আমার বেশ প্রিয় বেলের আচার।

- ঝোলটা আরেকটু দেবো?

- দিন। আপনার রান্নার হাতও বেশ ভালো।

আমি হেসে বললাম, রুটিটা একটু পুড়ে গেছে। তাও বলছেন? রবিন শেষটুকু খেয়ে বলল, ভালো হাতের পোড়া রুটিও অমৃত হয়। বলে উঠে চলে গেলেন মাইশার কাছে। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে দোলনায়। মাথায় হাত বুলিয়ে ল্যাপটপটা খুলে পাশে বসলেন।

পরদিন থেকে অফিস। মাত্র তিন দিনের ছুটি নিয়েছিলেন। বলতে গেলে পেয়েছেন আর কি। প্রথম বিয়ে হলে হয়ত সপ্তাহ খানেক ছুটি পেতেন। বের হওয়ার সময় জুতো পরতে পরতে বললেন, আমার খুব শখ ছিল কাজে যাওয়ার আগে বউয়ের কপালে ভালোবাসার চিহ্ন দিয়ে যাবো। কিন্তু নুপুরের কাছে এটা ন্যা*কামি ছিল। তাই কখনো এই শখ পূরণ হয়নি। আপনারও কি অপছন্দ? আমি ল*জ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ালাম। তিনি হেসে আমার কপালে চু*মু এঁকে দিলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন।

রান্না করতে করতে মেহরাজের কথা অনেক মনে পড়ল। মেহরাজেরও বেলের আচার অনেক প্রিয় ছিল। এক বসাতে একটা বয়াম শেষ করে ফেলে বলতো কাল বেল কিনে আনবো, মাকে বলো তো আচার বানাতে। আমিও শিখেছিলাম। একবছর হলো ও নেই। তাই বানানো হয়নি আর। মাইশা যখন পেটে তিন মাস হবে তখনই হঠাৎ কার এক্সি*ডেন্টে চলে গেল না ফেরার দেশে। মেয়েটাকে দেখে যেতে পারেনি। আমরা নাম ঠিক করে রেখেছিলাম। ওর পছন্দের নামটাই দিলাম আকিকার সময়। কত ঝগড়া করেছিলাম নাম নিয়ে ওর সাথে! চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়ালো। সেগুলো টুপ করে পড়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি রবিন কল দিয়েছেন। ধরতেই বললেন, কি করছেন? নাক টানছেন যে। কাঁদছিলেন নাকি? আমি নাকটা মুছে নিয়ে বললাম, পেঁয়াজ কাটছিলাম।

- ও, রান্না করবেন তাহলে। আমার মেয়ে কি করে?

- খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে এখন।

- আমি তো দুপুরে এখানে লাঞ্চ করি। আপনার অসুবিধা হবে না তো?

- না সমস্যা নেই। আপনি খেয়ে নেবেন।

- আপনিও। কোনো ফাঁকিবাজি যাতে না করেন। খেয়ে তারপর কাজ থাকলে করবেন।

- আচ্ছা।

- রাখছি তাহলে?

- হুম

রবিন ফোন কে*টে দিলেন। আমি রান্নাঘরে যেতে যেতে ভাবলাম, দুজন মানুষ কি করে একই হয়!

রাত আটটায় বেল বাজলো। আমি মাইশাকে কোলে নিয়ে টিভি দেখছিলাম। গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম রবিন দাঁড়িয়ে আছেন। ঘেমে আছেন পুরোটা। আমি দরজা খুলতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। সোফায় বসতেই ফ্যান ছেড়ে দিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিলাম। সেটা খেয়ে ফ্রেশ হতে গেলেন। আমি সোফায় বসে আছি। তিনি ব্যাগ থেকে পাঁচটা বকুল লতা বের করে বললেন, আম্মুর কাছে শুনেছি আপনার নাকি বকুল পছন্দ। তাই আনলাম। সে একটা লতা নিয়ে মাইশার হাতে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা আমার মেয়ের। বাকি চারটা লতা আমার খোঁপায় লাগিয়ে দিয়ে বললেন, আর এগুলো আমার মেয়ের আম্মুর। আমি লজ্জায় মুচকি হাসলাম। তিনি বললেন, লজ্জা পেলে আপনাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগে।

সাত মাস চলছে আমাদের সংসারের। রবিন বেশ খেয়াল রাখেন। আমার টুকটাক ভালো লাগাগুলো তিনি বেশ গুরুত্ব দেন। আর মাইশা বলতে পা*গল। মেয়েটাও বাবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়ায় যতক্ষণ বাসায় থাকে। অফিসে গেলেই মেয়ের কি কান্না! এখন হাঁটতে পারে একটু আধটু। কলিং বেলের শব্দ পেলেই সব ফেলে বসার ঘরে চলে আসে বাবার কোলে ওঠার জন্য। ভালোই কাট*ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ তার প্রাক্তন স্ত্রী এসে হাজির। আমি তখন রান্নায় ব্যস্ত। প্রায় শেষ। জুম্মার নামাজ পড়ে এসে মেয়েকে নিয়ে খেলা করছিলেন তিনি। তখনই কলিংবেল বাজল। দরজা খুলতেই নুপুর এসে ঢুকল।

রবিন চুপ করে চেয়ে আছে তার দিকে। নুপুরকে বেশ বিধ্বস্ত লাগছে। ঢুকেই রবিনর দিকে কাঁদো কাঁদো হয়ে এগিয়ে এসেছিল জড়িয়ে ধরার জন্য। তিনি মাইশাকে কোলে নিয়ে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বললেন, কেন এসেছো?

- একটু ঠাঁই পেতে এসেছি, রবিন।

- দুঃখিত। এটা কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নয়।

- প্লিজ রবিন আমাকে ফিরিয়ে দিও না। রায়হানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর বুঝেছি আমি কি হারিয়েছি। ও আমার সাথে খুবই বা*জে বিহেভ করে। ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমি ফিরে আসতে চাই রবিন।

- সরি নুপুর, আমি আমার মেয়েকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।

- তাহলে রেখে দাও ওকে। এমনিতেও তো তুমি বাবা হতে পারবে না। আমরা দুজন ওকে মানুষ করব।

এবার বেশ রেগে গেলেন রবিন। বললেন, তোমার মতো স্বার্থপর মেয়ে আমি দুটো দেখিনি। যখন সময় ছিল তখন নিজের স্বার্থ দেখে আমাকে ভেঙেচুরে চলে গিয়েছিলে। আজ এসেছো ফিরতে। তাও আমার স্ত্রীর সামনে এমন কথা বলেছো? আর যাই হোক সে তোমার মতো নয়। আমি বেশ সুখে আছি। তুমি সুখে নেই এটা তোমার সমস্যা। এখন আসতে পারো। তোমার মতো মানুষের ছায়া আমার সুখের সংসারে পড়ুক আমি চাই না। চলে যাও। নুপুর অনেক কাকুতি মিনতি করতে চেয়েছিল কিন্তু রবিন সুযোগ দিল না। তাকে গলাতে না পেরে হতাশ হয়ে বেরিয়ে গেল নুপুর।

বিকালে বারান্দায় মাইশাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ আমার হাত ধরে বলল, আমার সাথে এসো তো। ছাদে নিয়ে গেল। দেখলাম রংধনু উঠেছে৷ অনেকদিন দেখা হয় না। তিনি আমার হাত শক্ত করে ধরে বললেন, মেহরাজ ভাই আমার জন্য রত্ন রেখে গেছেন। এই রত্ন আমি হারাতে চাই না, আয়েশা। বলেই মাইশা আর আমার কপালে চু*মু এঁকে দিলেন।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.