মিসির আলি- নিশীথিনী-০৫

মিসির আলি- নিশীথিনী-০৫



০৫. নীলুর বাবা জাহিদ সাহেব


বছরখানেক হল নীলুর বাবা জাহিদ সাহেবের স্বাস্থ্য দ্রুত ভাঙতে শুরু করেছে। এমন কিছু অসুখ তাঁকে ধরেছে, যা শুধু কষ্টকর নয়, অত্যন্ত বিরক্তিকর। কিছুই হজম হয় না। পানি মেশান দুধ, লেবুর রস দিয়ে বার্লি, এক স্নাইস রুটি বা শিং মাছের মশলাবিহীন ঝোল–কিছুই না। ডাক্তার প্রায় সবই দেখানো হয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, লিভার কাজ করছে না। ডাক্তারদের শুকনো ধরনের কথাবার্তা, ইতস্তত ভাবভঙ্গি থেকে তাঁর ধারণা হয়েছে।–অসুখটা জটিল। হয়তো-বা লিভার ক্যানসারট্যানসার বাঁধিয়ে বসেছেন। ডাক্তাররা সরাসরি তাঁকে কিছু বলেন না। তিনিও জিজ্ঞাসা করতে ঠিক সাহস পান না। নীলুর সঙ্গে এই নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা বলে না। তিনি কিছু একটা বলতে শুরু করলে মন দিয়ে শোনে, কিন্তু কথার মাঝখানে এমন একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে বসে যে, তাঁর ধারণা হয় নীলু আসলে কিছু শুনছে না। শুধু তাকিয়েই আছে।

নীলুকে ইদানীং তিনি ভয় করেন। যে-নীলু। তাঁর সঙ্গে থাকে, তাকে তাঁর নিজের মেয়ে বলে কখনো মনে হয় না। এ যেন একটি অচেনা মেয়ে—যাকে কোনোদিনই ঠিক চেনা যাবে না।

অবশ্যি নীলু। তাঁর সঙ্গে একেবারেই যে কথাবার্তা বলে না, তা নয়। কথাবার্তা বলে। এসে জিজ্ঞেস করে, চা লাগবে বাবা? এই পর্যন্তই। তিনি যদি বলেন লাগবে, তাহলে সে উঠে গিয়ে চা বানিয়ে কাজের ছেলেটির হাতে পাঠিয়ে দেবে। যদি বলেন লাগবে না, তাহলে চুপ করে যাবে। দ্বিতীয় কোনো কথা বলবে না।

জাহিদ সাহেব আজকাল তাঁর দ্বিতীয় মেয়েটির অভাব খুব অনুভব করেন। সে পাশে থাকলে বাসার অবস্থা হয়তো আরেকটু স্বাভাবিক হত। বিলুর বিয়েটা তিনি ভালো দিতে পারেন নি। অথচ তখন মনে হয়েছিল, কী চমৎকার একটি ছেলে। তিনি বারবার জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি দেশে চলে আসবে তো বাবা? বিদেশে সেটুল করবে না তো? আমি আমার মেয়েকে দেশান্তরী করতে চাই না। আমি একা মানুষ, আমি চাই আমার দুটি মেয়ে আমার আশেপাশেই থাকবে।

বিলুর বর হাসিমুখে বলেছে, বিদেশে সেটুলু করব কেন? কী আছে ওখানে? মানুষ হিসেবে কোনো দাম আছে আমাদের? আমি বছরখানেক থাকব। কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরব। মাথা গুজব্বার মতো একটা বাড়ি তো কিনতে হবে।

জাহিদ সাহেব ছেলের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু এখন জানতে পেরেছেন, সে মনটানাতে একটা বাড়ি কিনেছে। যে-ছেলে দেশে চলে আসবে, সে নিশ্চয় বিদেশে বাড়ি কেনে না। তা ছাড়া, বিলু সুখী হয় নি বলে তাঁর ধারণা। বিলুর চিঠিপত্রে অবশ্য কিছু লেখা থাকে না। কিন্তু চিঠিগুলো প্রাণহীন। যেন লেখার জন্যেই লেখা। দায়িত্ব পালনের চিঠি। এক জন সুখী মেয়ের চিঠিতে থাকবে আনন্দের ছবি। সে তার বরের কথাইনিয়ে—বিনিয়ে লিখবে। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে উদ্ধৃসি থাকবে। সে-সবকিছু থাকে না। বাবা হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি। সৎপাত্রে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেন নি। অথচ ছেলেটিকে সত্যি সত্যি তাঁর পছন্দ হয়েছিল। ভদ্র ছেলে। চমৎকার কথাবার্তা। দারুণ শাপ। সেই সঙ্গে রসিক। খাওয়ার টেবিলে একবার সে এক গল্প শুরু করল। এক দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকে এক ভণ্ড তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেছে। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে তর্কযুদ্ধ দেখতে! দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত মঞ্চে বসে আছেন।– ভও পণ্ডিত ঢুকল এবং গভীর হয়ে বলল,–ফুন ফুনাফুনি? দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তিনি তাঁর সারাজীবনে~~ফুন ফুনাফুন বলে কিছু শোনেন নি। এর মানে কী, তা তাঁর জানা নেই।

ভারি মজার গল্প। জাহিদ সাহেব গল্প শুনে হাসতে হাসতে বিষম খেলেন। নীলুর মতো গভীর মেয়েও হেসে ফেলল। এই কি সেই ছেলে?

জাহিদ সাহেব আজকাল বেশির ভাগ সময়ই বারান্দায় বসে এইসব কথা ভেবে ভেবে কাটান। দু-তিনটে পত্রিকা তার হাতের কাছে থাকে, সে-সব পড়া হয় না। পনের খণ্ড মুক্তিযুদ্ধের দলিল কিনেছেন। শখ ছিল গোড়া থেকে পড়বেন, তা পড়তে পারছেন না! ইচ্ছা করে না। মাঝে-মাঝে শুধু অষ্টম খণ্ডে চোখ বুলিয়ে যান। অষ্টম খণ্ড হচ্ছে অত্যাচার ও নিযািতনের কাহিনী। পড়তে-পড়তে তাঁর বুক হুহু করে।

আজও তাই করছিলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন, নীলু। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু নিঃশব্দে চলাফেরা করে। হঠাৎ উপস্থিত হয়ে চমকে দেয়। জাহিদ সাহেব বললেন, কি খবর মা?

কোনো খবর নেই বাবা।

কোথাও বেরুচ্ছিস?

না।

নীলু বসল। তাঁর পাশের চেয়ারে। তিনি লক্ষ করলেন, নীলু। বেশ সাজগোজ করেছে। কপালে টিপ। সুন্দর একটি শাড়ি। খোঁপায় ফুল পর্যন্ত দিয়েছে। জাহিদ সাহেব বললেন, তোর স্যার তো আর এলেন না।

উনি এসেছিলেন। বাড়ি চিনতে পারেন নি। রিকশা করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে দু বার গেলেন।

তুই দেখছিস?

নীলু কিছু বলল না। সে দেখে নি। না দেখেই বলেছে। খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জাহিদ সাহেব জানেন, অস্বাভাবিক হলেও এটা সত্যি। নীলু না-দেখেই অনেক কিছু বলতে পারে। কেমন করে পারে, তা তিনি জানেন না। জানতে চানও না। নীলুর এই অস্বাভাবিক ক্ষমতাকে তিনি ভয় করেন।

কোনোদিন ভোরবেলায় নীলু। এসে যদি বলে, বাবা, আজ তোমার দিনটি ভালো যাবে। আজ বিলুর চিঠি পাবে।

তিনি হাসতে চেষ্টা করেন, কিন্তু হাসি ঠিক আসে না।

চিঠির সঙ্গে ছবিও পাবে। সুন্দর-সুন্দর ছবি পাঠিয়েছে বিলু!

তই নাকি?

হ্যাঁ।

নীলু হাসে। এই নীলু আগের নীলু নয়। এই নীলুকে তিনি চেনেন না।

সাহেব বললেন,  তোর স্যার এসেছিলেন, তাঁকে ডেকে ঘরে আনলি না কেন?

উনি নিজেই খুঁজে বের করবেন। আমাদের এই স্যার কোনো জিনিসই মাঝপথে ছেড়ে দেন না।

তাই নাকি ?

হ্যাঁ। খুব মেথডিকেল মানুষ। তোমার সঙ্গে তো বাবা ওঁর সাথে এক বার দেখা হয়েছিল।

আমার মনে নেই।

নীলু হাসতে-হাসতে বলল, স্যারটা খুব আনইমপ্রেসিভ। তাঁর কথা মনে না থাকারই কথা।

জাহিদ সাহেব নীলুর গলায় এক ধরনের আবেগ অনুভব করলেন। এই আবেগের কারণ কী? তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললেন, খুব গরম পড়েছে। এ-বছর।

নীলু বলল, প্রতি বছর গরমের সময় তুমি এই কথাটা বল। আবার শীতের সময় বল– এ বছর মারাত্মক শীত পড়েছে। বল না বাবা?

বলি বোধহয়।

আমরা বেঁচে থাকি বৰ্তমানকে নিয়ে। অতীতের কথা আমাদের কিছু মনে থাকে না।

কথাটা কি ঠিক? না, ঠিক নয়। কিছু-কিছু অতীত তার কালো সীল শক্ত করে বসিয়ে দেয়, কিছুতেই তা তুলে ফেলা যায় না। নীলুর বিয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি প্রথম তা লক্ষ করলেন। যে-কোনো আলাপ অল্প কিছুদূর এগোেনর পরই বরপক্ষের লোকজন জানতে পেরে যায়, তাঁর এই মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল একটি বাড়িতে! যে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সে এক জন ভয়াবহ খুনী। কিন্তু কাউকেই তিনি বিশ্বাস করাতে পারেন নি যে, সেই খুনী নীলুকে স্পর্শ করতে পারে নি। কোনো- এক রহস্যময়কারণেতার মৃত্যু হয়েছিল। পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টেডাক্তার অবশ্যি লিখেছিল–মস্তিষ্কে রক্তক্ষরসুন্টু নুসুম ঘুঘু, কিন্তু ছিদ্র সাহেব তা বিশ্বাস করেন না। তিনি জানেন মৃত্যুর কারণ অমীমাংসিতু এবং রহস্যময়।

সেই রহস্য তাঁর মেয়েকে এখনো ঘিরে আছে। তিনি তা চান না। তিনি তাঁর মেয়ের জন্যে একটি সহজ স্বাভাবিক জীবন চান। একটি ছোট্ট সুখী সংসার। দুটি শিশু–তিনি যাদের হাত ধরে পার্কে বেড়াতে যাবেন। বাদাম কিনে দেবেন। এক জন হঠাৎ পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে। তিনি কোলে নিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করবেন। তাই দেখে অন্যজনের হিংসা হবে। তাকেও কোলে নিতে হবে; কেউ তখন আর কোল থেকে নামতে চাইবে না। বড় ঝামেলায় পড়ে যাবেন তিনি।

তাঁর চিন্তায় বাধা পড়ল। নীলু। হেসে উঠল খিলখিল করে। পুরনো দিনের নীলুর মতো। জাহিদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, হাসছিস কেন?

তুমি কী অদ্ভুত সব কল্পনা কর বাবা!

নীলু হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। জাহিদ সাহেব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। এ কোন নীলু? এই ভয়ঙ্কর ক্ষমতার উৎস কী?