মিসির আলি-নিশীথিনী -০১

মিসির আলি-নিশীথিনী -০১



০১. মিসির আলির ধারণা 


মিসির আলির ধারণা ছিল, তিনি সহজে বিরক্ত হন না। এই ধারণাটা আজ ভেঙে যেতে শুরু করেছে। ঠিক এই মুহূর্তে তিনি অসম্ভব বিরক্ত। যে-রিকশায় তিনি উঠেছেন, তার সীটটা ঢালু। বসে থাকা কষ্ট্রের ব্যাপার। তার চেয়েও বড় কথা, দু মিনিট পরপর রিকশার চেইন পড়ে যাচ্ছে।

এখন বাজছে দশটা তেইশ। সাড়ে দশটায় থার্ড ইয়ার অনার্সের সঙ্গে তাঁর একটা টিউটরিঅ্যাল আছে। এটা কোনোক্রমেই ধরা যাবে না। যে-হারে রিকশা এগুচ্ছে, তাতে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছতে তাঁর আরো পনের মিনিট লাগবে। এ-কালের ছাত্ররা এতক্ষণ তাদের টীচারদের জন্যে অপেক্ষা করে না।

মিসির আলি তাঁর বিরক্তি ঢাকবার জন্যে একটা সিগারেট ধরালেন। ঠিক তখন পঞ্চম বারের মতো রিকশার চেইন পড়ে গেল। রিকশাওয়ালার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে চেইন পড়ার ব্যাপারটায় সে আনন্দিত। গদাইলশকরী চালে সে নামল এবং সামনের চাকাটা তুলে ঝাঁকাঝাঁকি করতে লাগল।

চেইন পড়ে গেলে কেউ চাকা তুলে ঝাঁকাঝাঁকি করে বলে তাঁর জানা ছিল না। রুক্ষ গলায় বললেন, এ রকম করছি কেন?

জবাব দিল না। গরম চোখে তাকাল এবং মিসির আলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একটা বিড়ি ধরাল। মিসির আলি রাগ সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কুড়ি থেকে এক পর্যন্ত উল্টো দিকে গুনলেন। জীবনানন্দ দাশের মনে হয় একদিন কবিতার প্রথম চার লাইন মৃদু স্বরে আওড়ালেন। মিসির আলির ধারণা, কিছু-কিছু কবিতা মানুষের অস্থিরতা কমিয়ে দেয়। মনে হয় একদিন এমন একটি কবিতা।

কিন্তু আজ তাঁর রাগ কমছে না। রিকশাওয়ালা কঠিন মুখ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি টানছে। মিসির আলির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।

মিসির আলি নিজেকে সামলাবার জন্যেই ভাবতে লাগলেন–তিনি নিজে যদি সিগারেট ধরাতে পারেন, তাহলে এই লোকটি পারবে না কেন? জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে বেচারা ক্লান্ত ও বিরক্ত। এক জন ক্লান্ত ও বিরক্ত মানুষের নিশ্চয়ই বিশ্রাম করার অধিকার আছে। তিনি হালকা গলায় বললেন, নাম কি তোমার?

সামসু।

বাড়ি কোথায় তোমার সামসু?

বাড়ি-ঘর নাই।

দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। সামসু, রিকশা চালাও। ক্লাস মিস হবে।

সামসু কোনো পাত্তাই দিল না। রাস্তার পাশে পেচ্ছাব করতে বসে গেল। তার বসার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে সে সহজে উঠবে না, বসেই থাকবে। এই লোকটি কি কোনো-একটি অজ্ঞাত কারণে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছে?

মিসির আলি রিকশা থেকে নেমে পড়লেন। পাঁচ টাকা ভাড়া ঠিক করা ছিল, তিনি ছটাকা দিলেন। সহজ স্বরে বললেন, নাও, ভাড়া নাও! আমি হেঁটে চলে যাব।

সাধারণত রিকশাওয়ালদের সবচেয়ে ময়লা ন্যাতন্যাতে নোটগুলো দেয়া হয়। মিসির আলি তাকে দিয়েছেন কচকচে নতুন নোট। এটা তিনি করলেন এই আশায়, যাতে সামসু নামের এই উদ্ধত যুবকটি তাঁর আচরণের জন্যে লজ্জিত বোধ করে।

এ-রকম কাণ্ডকারখানা মিসির আলি সাহেব করে থাকেন। একবার বাসে তার পাশে সুখী-সুখী চেহারার এক বুড়ে বসল। দু জনের সীট। কিন্তু বুড়ো অকারণে পা ফীক করে তাঁকে চাপ দিতে লাগল। বিশ্ৰী কাণ্ড! মিসির আলি খানিকক্ষণ চাপ সহ্য করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, আপনার বোধহয় অল্প জায়গায় বসার অভ্যোস নেই, আপনি বরং একাই এখানে আরাম করে বসুন!

মিসির আলি ভেবেছিলেন, লোকটি এতে লজ্জিত ও বিব্রত হবে। সে-রকম কিছু হল না। লোকটি নির্বিকার ভঙ্গিতে দু জনের জায়গা দখল করে পা দোলাতে লাগল। এরা অসুখী মানুষ। নিজেদের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা এরা–অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। ঢাকা শহরে অসুখী মানুষের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে কেন ভাবতে ভাবতে মিসির আলি দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। মাথার ওপর জুন মাসের গানগনে আকাশ। রাস্তাঘাট তেতে উঠেছে। বাতাসের লেশমাত্ৰও নেই। এ-বছর অসম্ভব গরম পড়েছে। এই অসহ্য গরমে রিকশাওয়ালারা মানুষ টানে কীভাবে কে জানে। মিসির আলি সামসু নামের উদ্ধত যুবকটির জন্যে এক ধরনের মায়া অনুভব করলেন।

ক্লাস ফাঁকা। আসমানী রঙের জামদানি শাড়ি পরা একটি মেয়ে শুধু সেকেন্ড বেঞ্চে বসে আছে। মেয়েটির মাথায় ঘোমটা! এটা একটা নতুন ব্যাপার। ইউনিভার্সিটির মেয়েরা মাথায় ঘোমটা দেয় শুধু আজানের সময়।

মিসির আলি ঢুকতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। তিনি অপ্ৰস্তুত স্বরে বললেন, দেরি করে ফেললাম। সবাই চলে গেছে নাকি?

জ্বি স্যার!

তুমি বসে আছ কেন? তুমি কেন ওদের সঙ্গে গেলে না?

মেয়েটি মৃদু স্বরে বলল, স্যার, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না?

ধুলিতে পারছি। তোমার নাম নীলু।

জ্বি।

তুমি তো এই ক্লাসের নও।

জ্বি-না।

তাহলে?

আমি স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে বসে আছি। আমি রুটিনে দেখেছি, আজ। আপনার এখানে ক্লাস।

মিসির আলি ভুরু কুঁচকে বললেন, তোমার কি বিয়ে হয়েছে? মাথায় ঘোমটা, তাই বললাম। নতুন বিয়ে-হওয়া মেয়েরা প্রথম দিকে ঘোমটা পরে।

আমার বিয়ে হয় নি।

ও, আচ্ছা!

আপনার সঙ্গে আমার খুব একটা জরুরি কথা আছে স্যার।

বল।

আমি স্যার অনেকটা সময় নিয়ে কথাটা আপনাকে বলতে চাই। আমি কি স্যার আপনার বাসায় যেতে পারি?

বাসায় আমার কিছু ঝামেলা আছে।

তাহলে স্যার, আপনি কি আমাদের বাসায় একটু আসবেন? আমার খুব দরকার।

ঠিক আছে, যাব।

আমাদের বাসার ঠিকানা কি আপনার মনে আছে? এক বার গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়! আমাদের বাসার দোতলায় আপনার এক জন পরিচিত মহিলা থাকতেন। রানু। 

আমার মনে আছে।

স্যার, আপনি কি আজই আসবেন? আমার খুব দরকার।

মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। এই মেয়ের নাম নীলু, কিন্তু কোনোএক বিচিত্র কারণে তাকে অবিকল রানুর মতো দেখাচ্ছে।

স্যার, আপনি কি আজই যাবেন?

ঠিক আছে রানু।

আমার নাম কিন্তু স্যার নীলু।

মিসির আলি লক্ষ করলেন, মেয়েটা হাসছে। যেন তাকে রানুবলায় সে খুশি। এটাই যেন আশা করছিল।

আমাদের বাসার ঠিকানা কি লিখে দেব?

লিখে দিতে হবে না। আমার মনে আছে।

আসবেন কিন্তু স্যার।

আসব। আমি আসব।

যাই স্যার, স্নামালিকুম।

নীলু উঠে দাঁড়াল। এত সুন্দর মেয়াটা শ্যামলা গায়ের রঙ। চোখে-মুখে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু তবু এমন মায়া জাগিয়ে তুলছে কেন? মিসির আলি লজ্জিত বোধ করলেন। তাঁর বয়স একচল্লিশ। এই বয়সের এক জন মানুষের মনে এজাতীয় তরল ভাব থাকা উচিত নয়। তা ছাড়া এই মেয়েটি তাঁর ছাত্রী।

মিসির আলি শূন্য ক্লাসে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। একসঙ্গে বেশ কয়েকটা জিনিস নিয়ে তিনি ভাবছেন। মেয়েটির মাথায় ঘোমটা কেন? এই মেয়েটি দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাসে আসছে না কেন? মেয়েটি চলে যাবার সময়ও একটা অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। সোজাসুজি হেঁটে গেছে, এক বারও পেছনে ফিরে তাকায় নি। মেয়েরা সাধারণত পেছন ফিরে তাকায়।

সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপারটি হচ্ছে, একটি মৃতা মেয়ের ছাপ আছে নীলুর মধ্যে। যেভাবেই হোক আছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না।

তিনি সিগারেট ধরালেন।

প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না। কথাটা কি সত্যি? তাঁর মনে হল, সত্যি নয়। কাজই হচ্ছে নানান রকম রহস্য সৃষ্টি করা-মানুষের কাজ হচ্ছে সেই রহস্যের কুয়াশা সরিয়ে দেয়। এমন একদিন কি আসবে, যখন কেউ বলবে না। দেয়ার আর মেনি থিংকস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ…।

আরে, মিসির আলি সাহেব না? এখানে কী করছেন? এক-একা ক্লাসে বসে আছেন কেন?

তিনি দাড়িওয়ালা এই লোকটাকে চিনতে পারলেন না; হাতে রেজিষ্টি খাতা, কাজেই অধ্যাপক হবেন। মুখখানা হাসি-হাসি। পান খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলেছেন। পান-খাওয়া লোকজন কি কিছুটা নম্ন স্বভাবের হয়? মিসির আলির মনে হল, পান এবং স্বভাবের ভেতর কোনো- একটা সম্পর্ক আছে। তিনি যে ক জন পানবিলাসী লোককে চেনেন, তাদের সবাই সদালাপী।

কি, কথা বলছেন না কেন? কিছু ভাবছেন নাকি?

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত ও নরম স্বরে বললেন, জ্বি-না, কিছু ভাবছি না।

আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না?

জ্বি-না।

দাড়িওয়ালা অধ্যাপক অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। মিসির আলি বিব্রত বোধ করলেন। কাউকে চিনতে পারছি না বলা।–তাকে প্রায় অপমান করার শামিল। বিশেষ করে অধ্যাপক শ্রেণীর মানুষরা এ ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর।

সত্যি চিনতে পারছেন না?

জ্বি না। আমার একটা প্রবলেম আছে, কিছুই মনে থাকে না।

মাসখানেক আগে আমি আপনার কাছে এক জন রোগী নিয়ে গিয়েছিলাম–ফিরোজ নাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনি ফিরোজের দুলাভাই।

হ্যাঁ দুলাভাই।

এবং আপনার নাম হচ্ছে নাজিমুদ্দিন। হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট।

এই তো চিনতে পারছেন।

চিনতে পারছি এসোসিয়েশন থেকে একটা মনে পড়লে, অন্যগুলো মনে পড়তে থাকে। এসোসিয়েশন অব আইডিয়াস।

ফিরোজ তো অনেকখানি ইমপ্রুভ করেছে। এত অল্প সময়ে যে আপনি এতটা করবেন, আমরা কেউ কল্পনাও করি নি। দারুণ ব্যাপার!

মিসির আলি কিছু বললেন না। ফিরোজ আজ বিকেলে তাঁর কাছে আসবে। প্রতি সোমবার ফিরোজের সঙ্গে তাঁর একটি সেশন হয়। অথচ নীলুকে বলে রেখেছেন, আজ যাবেন তাদের বাসায়। তাঁর কাজকর্ম ইদানীং এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? বয়স বাড়ছে।

মিসির আলি সাহেব!

জ্বি।

চলুন, লাউঞ্জে বসে চা খাওয়া যাক।

চলুন।

আপনি এত গম্ভীর হয়ে আছেন কেন? কী ভাবছেন এত?

কিছু ভাবছি না। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘনিঃশ্বাসটি কেন ফেললেন, এই নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন। অকারণে তো কেউ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে না। সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকে। এই জগতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না, সবই লজিক। জটিল লজিক জটিল কিন্তু অভ্রান্ত। লজিকের বাইরে এক চুলও কারোর যাবার ক্ষমতা নেই।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.