মাস্টার মহাশয় (প্রথম পরিচ্ছেদ)

মাস্টার মহাশয় (প্রথম পরিচ্ছেদ)


কিঞ্চিদধিক পঞ্চাশৎ বৎসর পূর্বে, বর্ধমান শহর হইতে ষোলো ক্রোশ দূরে, দামোদর নদের অপর পারে, নন্দীপুর ও গোঁসাইগঞ্জ নামক পাশাপাশি দুইটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল; এবং উভয় গ্রামের সীমারেখার উপর একটি প্রাচীন সুবৃহৎ বটবৃক্ষ দণ্ডায়মান ছিল। এখন সে গ্রাম-দুখানিও নাই, বটবৃক্ষটিও অদৃশ্য - দামোদরের বন্যা সে-সমস্ত ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে।

ফাল্গুন মাস। এক প্রহর বেলা হইয়াছে। গোঁসাইগঞ্জের মাতব্বর, প্রজা এবং গ্রামের অভিভাবক স্থানীয় কায়স্থ সন্তান শ্রীযুক্ত হীরালাল দাস দত্ত মহাশয় হুঁকা হাতে করিয়া ধূমপান করিতেছিলেন। প্রতিবেশী শ্যামাপদ মুখুয্যে ও কেনারাম মল্লিক (ইহারাও বড় প্রজা) নিকটে বসিয়া, এ বৎসর চৈত্রমাসে বারোয়ারি অন্নপূর্ণা পূজা কিরূপভাবে নির্বাহ করিতে হইবে, তাহারই পরামর্শ করিতেছিলেন।

পার্শ্ববর্তী নন্দীগ্রামেও প্রতি বৎসর চাঁদা করিয়া ধুমধামের সহিত অন্নপূর্ণা পূজা হইয়া থাকে। এ বৎসর গুজব শুনা যাইতেছে উহারা অন্যান্য বৎসরের মতো যাত্রা তো আনিবেই, অধিকন্তু কলিকাতায় কোনো টপওয়ালীকেও বায়না দিয়া আসিয়াছে। ঢপসঙ্গীত এ-অঞ্চলে ইতিপূর্বে কখনও শুনা যায় নাই। এ গুজব যদি সত্য হয় তবে গোঁসাইগঞ্জেও শুধু যাত্রা আনিলে চলিবে না ঢপ আনিতে হইবে।

উহারা কোন উপওয়ালীকে বায়না দিয়াছে, সেই গোপন-সংবাদটুকু সংগ্রহ করিবার জন্য গুপ্তচর নিযুক্ত হইয়াছে। তাহার নামটি 'সঠিক' জানিতে পারিলে, বর্ধমানে অথবা কলিকাতায় গিয়া খবর লইতে হইবে সেই চপওয়ালী অপেক্ষা কোন চপওয়ালী সমধিক খ্যাতিসম্পন্না এবং সেই বিখ্যাত চপওয়ালীকে গাগুনা করিবার বায়না দিতে হইবে ইহাতে যত টাকা লাগে লাগুক। কারণ গোঁসাইগঞ্জবাসিগণের একবাক্যে ইহাই মত যে, তিনপুরুষ ধরিয়া গোঁসাইগঞ্জ কোনো বিষয়েই নন্দীপুরের নিকট হটে নাই এবং আজিও হটিবে না।

আগামী বারোয়ারি পূজা সম্বন্ধে যখন গ্রামস্থ তিনজন প্রধান ব্যক্তির মধ্যে উল্লিখিত প্রকার গভীর ও গূঢ় আলোচনা চলিতেছিল, সেই সময় রামচরণ মণ্ডল হাঁপাইতে হাপাইতে সেইখানে আসিয়া পৌছিল এবং হাতের লাঠিটা আছড়াইয়া ফেলিয়া ধপাস করিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। তাহার ভাবভঙ্গি দেখিয়া হীরু দত্ত সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হে মোড়লের পো, অমন করে বসে পড়লে কেনা কী হয়েছে।"

রামচরণ দুইচক্ষু কপালে তুলিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করছেন দত্তজা, কী হতে আর বাকি আছে? হায় হায় হায় — কার্তিক মাসে যখন আমার জ্বরবিকার হয়েছিল, তখনই আমি গেলাম না কেন? এই দেখবার জন্যে কি আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলি হারে বিধেতা, তোর পোড়াকপাল!”

শ্যামাপদ ও কেনারামও ঘোর দুশ্চিন্তায় রামচরণের পানে চাহিয়া রহিলেন। দত্তজা বলিলেন, “কী হয়েছে, কী হয়েছে? সব কথা খুলে বলো। এখন আসছ কোথা থেকে?”

দীর্ঘশ্বাস জড়িত স্বরে রামচরণ উত্তর করিল, "নন্দীপুর থেকে। হায় হায়, শেষকালে নন্দীপুরের কাছে মাথা হেঁট হয়ে গেল। হারে কপাল!" বলিয়া রামচরণ সজোরে নিজ ললাটে করাঘাত করিল। দত্তজা জিজ্ঞাসা করিলেন, "কেন কেন? নন্দীপুরওয়ালারা কী করেছে?"

“বলছি। বলবার জন্যেই এসেছি। এই রোদ্দুরে মশাই, একক্রোশ পথ ছুটতে ছুটতে এসেছি। গলাটা শুকিয়ে গেছে, মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। একঘটি জল-"

দত্তজার আদেশে অবিলম্বে এক ঘড়া এবং একটি ঘটি আসিল। রামচরণ উঠিয়া রোয়াকের প্রান্তে বসিয়া, সেই জলে হাত পা মুখ ধুইয়া ফেলিল; কিঞ্চিৎ পানও করিল। তারপর হাতমুখ মুছিতে মুছিতে নিকটে আসিয়া বসিয়া, গভীর বিষাদে মাথাটি ঝুঁকাইয়া রহিল।

হীরু দত্ত বলিলেন, “এবার বলো কী হয়েছে, আর দগ্ধে মেরো না বাপু!”

রামচরণ বলিল, “কী হয়েছে। যা হবার নয় তাই হয়েছে। বড় বড় শহরে যা হয় না, নন্দীপুরে তাই হয়েছে। এসব পাড়াগাঁয়ে কেউ কখনও যা স্বপ্নেও ভাবেনি, তাই হয়েছে। তারা হুস্কুল বসিয়েছে।”

তিনজনেই সমবেত স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কী আবার? হুস্কুল কী।"

রামচরণ বলিল, “আরে ছাই আমিই কি জানতাম আগে হুস্কুল কার নাম? আজ না শুনলাম! ইঞ্জিরি পড়ার পাঠশালাকে হুস্কুল বলে।”

দত্তজা বলিলেন, “ওহ্ ইস্কুল খুলেছে বুঝি?”

"হ্যাঁ গো হ্যাঁ তাই খুলেছে। একজন ম্যাস্টার নিয়ে এসেছে। ইঞ্জিরি পাঠশালের গুরুমশায়কে নাকি ম্যাস্টার বলে। দাশু ঘোষের চণ্ডীমণ্ডপে হুস্কুল বসেছে। স্বচক্ষে দেখে এলাম ম্যাস্টার বসে দশ-বারোজন ছেলেকে ইঞ্জিরি পড়াচ্ছে।"

হীরু দত্ত একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া, গালে হাত দিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, 'মাস্টার কোথা থেকে এনেছে তা কিছু শুনলে।”

“সব খবরই নিয়ে এসেছি। বর্ধমান থেকে এনেছে। বামুনের ছেলে— হারাণ চক্রবর্তী। পনেরো টাকা মাইনে, বাসা, খোরাক। সব খবরই নিয়ে এসেছি।”

বাহিরে এই সময়ে একটা কোলাহল শুনা গেল। পরক্ষণেই দেখা গেল, পিলপিল করিয়া লোক সদর- দরজা দিয়া প্রবেশ করিতেছে। রামচরণ পথে আসিতে আসিতে নন্দীপুরের হস্তে গোঁসাইগঞ্জের এই অভূতপূর্ব পরাভব-সংবাদ প্রচার করিয়া আসিয়াছিল। সকলে আসিয়া চিৎকার করিয়া নানা ছন্দে বলিতে লাগিল, “এ কী সর্বনাশ হল! নন্দীপুরের হাতে এই অপমান। আমাদের ইস্কুল খোলবার এখন কী উপায় হবে?”

হীরু দত্ত সেই রোয়াকের বারান্দায় দাঁড়াইয়া উঠিয়া, হাত নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন— “ভাই সকল! তোমরা কি মনে করেছ, তিনপুরুষ পরে আজ গোসাইগঞ্জ নন্দীপুরের কাছে হটে যাবে। কখনোই না । এ দেহে প্রাণ থাকতে নয়। আমরাও ইস্কুল খুলব। ওরা বা কী ইস্কুল খুলেছে, আমরা তার চতুর্থণ ভালো ইস্কুল খুলব। তোমরা শান্ত হয়ে ঘরে যাও। আজই খাওয়াদাওয়া করে আমি বেরুচ্ছি। কলকাতা যাবার রেল খুলেছে, আর তো কোনো ভাবনা নেই। আমি কলকাতায় গিয়ে ওদের চেয়েও ভালো মাস্টার নিয়ে আসব। ওরা ১৫ দিয়ে মাস্টার এনেছে? আমরা ২৫ মাইনে দেব। ওদের মাস্টারকে পড়াতে পারে এমন মাস্টার আমি নিয়ে আসব। আজ থেকে এক হপ্তার মধ্যে, আমার এই চণ্ডীমণ্ডপে ইস্কুল বসাব বসাব বসাব—তিন সত্যি করলাম। এখন যাও তোমরা বাড়ি যাও, স্নানাহার করোগে।"

"জয় গোঁসাইগঞ্জের জয়! জয় হীরু দত্তের জয়!”- সোল্লাসে চিৎকার করিতে করিতে তখন সেই জনতা প্রস্থান করিল।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.