মাস্টার মহাশয় (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)

মাস্টার মহাশয় (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)


কলিকাতা হইতে মাস্টার নিযুক্ত করিয়া হীরু দত্ত চতুর্থ দিবসে ফিরিয়া আসিলেন। মাস্টার মহাশয়ের নাম ব্রজগোপাল মিত্র। বয়স ত্রিশ বৎসর, খর্বাকার কৃশকায় ব্যক্তি, বড় মিষ্টভাষী। ইংরাজি বলিতে কহিতে লিখিতে পড়িতে নাকি ভারি ওস্তাদ। ইংরাজিটা তাঁর এতই বেশি অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে যে, লোকের সঙ্গে আলাপ করিতে করিতে মাঝে মাঝে ইংরাজি কথা মিশাইয়া ফেলেন—অজ্ঞ লোকের সুবিধার্থ আবার তাহা বাংলা করিয়া বুঝাইয়াও দেন। বলেন, পূর্বে পিতার জীবিতকালে, একদিন কলিকাতার গঙ্গার ধারে মাস্টার মহাশয় নাকি বেড়াইতেছিলেন, তথায় এক সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। সাহেব তাঁহার ইংরাজি শুনিয়া, লাটসাহেবের নিকট সে-গল্প করিয়াছিলেন। লাটসাহেব মাস্টার মহাশয়কে ডাকিয়া পাঠাইয়া, ডেপুটি কালেক্টরি পদ তাঁহাকে দিবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তখন তিনি বাপের বেটা, সংসারের চিন্তা ছিল না, সেই প্রস্তাব তিনি বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। আজ অভাবে পড়িয়া এই ২৫ টাকার চাকরি তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইল । পুরুষস্য ভাগ্যং!— মাস্টার মহাশয়ের মুখে এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া এবং তাঁহার ইংরাজিয়ানা চালচলন দেখিয়া গ্রামের লোক একেবারে মোহিত হইয়া গেল।

হীরু দত্তের প্রতিজ্ঞা অনুসারে পরদিনই ইস্কুল খুলিল। পনেরো-ষোলোটি ছাত্র লইয়া মাস্টার মহাশয় অধ্যাপনা আরম্ভ করিলেন। কলিকাতা হইতে (দত্তজার ব্যয়ে) তিনি প্রচুর পরিমাণে সেলেট, পেন্সিল ও মরে সাহেবের স্পেলিং বুক পুস্তক খরিদ করিয়া আনিয়াছিলেন, ছাত্রগণের উৎসাহ বর্ধনাথ সেগুলি তাহাদিগকে বিনামূল্যেই দেওয়া হইতে লাগিল।

গোঁসাইগঞ্জের লোকের সঙ্গে নন্দীপুরের লোকের পথেঘাটে দেখা হইলে, উভয় গ্রামের মাস্টার সম্বন্ধে আলোচনা হইত। গোঁসাইগঞ্জ বলিত—“বর্ধমানের মাস্টার, ও জানেই বা কী, আর পড়াবেই বা কী!” নন্দীপুর বলিত হলেই বা আমাদের মাস্টারের বর্ধমানে বাড়ি, তিনিও তো কলকাতাতেই লেখাপড়া শিখেছেন। এঁরা যখন পড়তেন, তখন কি বর্ধমানে ইংরিজি ইস্কুল ছিল? কলকাতায় গিয়ে ইংরিজি পড়তে হত।"

যথাসময়ে উভয় গ্রামের বারোয়ারি পূজার উৎসব আরম্ভ হইল। উভয় গ্রামই উভয় গ্রামের লোকদিগকে প্রতিমা দর্শন, প্রসাদ ভক্ষণ, যাত্রা ও ঢপ সংগীত শ্রবণের নিমন্ত্রণ করিল। এই উপলক্ষে উভয় মাস্টারের দেখাসাক্ষাৎ হইয়া গেল এবং সভাস্থলে প্রকাশ পাইল, উভয়ে পূর্বাবধি পরিচিত।

পূজান্তে গোঁসাইগঞ্জ একটা কথা শুনিয়া বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। নন্দীপুরের মাস্টার নাকি বলিয়াছেন—“ঐ বেজা বুঝি ওদের মাস্টার হয়ে এসেছে, তা এদ্দিন জানতাম না! ওটা তো মহামূর্খ। ছেলেবেলায় কলকাতায় আমরা এক কেলাসে পড়তাম কিনা। আমরা যখন সেকেন বুক পড়ি, সেই সময়েই ও ইস্কুল ছেড়ে দেয়। তারপর আর তো ও ইংরেজি পড়েনি। বড়বাজারে এক মহাজনের আড়তে খাতা লিখত, মাইনে ছিল সাতটাকা। গেল বছরও কলকাতায় ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়; তখনও তো ঐ চাকরি করছে।"

গোঁসাইগঞ্জবাসীরা ব্রজ মাস্টারকে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কী শুনছি।” ব্রজ মাস্টার এ প্রশ্ন শুনিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন—“একেই বলে কলিকাল। সেকেন বুক পড়ার সময় আমি ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম, না ও-ই ছেড়ে দিয়েছিল? হয়েছিল কী জানো না বুঝি? মাস্টার কেলাসে রোজ পড়া জিজ্ঞাসা করত, ও একদিনও বলতে পারত না। মাস্টার একদিন ওকে একটা কোশ্চেন জিজ্ঞাসা করলে ও এনসার করতে পারলে না। আমায় জিজ্ঞাসা করতেই আমি বললাম। মাস্টার আমায় বললে, 'দাও ওর কান মলে।' আমি কান মলে দিতেই, ওর মুখচোখ রাগে রাঙা হয়ে গেল। ও বলতে লাগল, আমি হলাম বামুনের ছেলে, ও কায়েত হয়ে কিনা আমার কানে হাত দেয়! সেই অপমানে ও-ই তো ইস্কুল ছেড়ে দিলে। আমি তারপর পাঁচ-ছ বছর সেই ইস্কুলে পড়ে, একেবারে লায়েক হয়ে তবে বেরুলাম।”

অতঃপর গোঁসাইগঞ্জের লোক, নন্দীপুর কর্তৃক ব্যক্ত ঐ অপবাদের প্রতিবাদ করিতে লাগিল। অবশেষে হারাণ মাস্টার বলিল, “আমরা ইস্কুলে যে-মাস্টারের কাছে পড়তাম, তিনি আজও বেঁচে আছেন। গোঁসাইগঞ্জ থেকে তোমরা দুজন মাতব্বর লোক আমার সঙ্গে চলো তাঁর কাছে; তাঁকে জিজ্ঞাসা করে দেখো কার কথা সত্যি কার কথা মিথ্যে।”

এ-কথা শুনিয়া ব্ৰজ মাস্টার হা-হা করিয়া হাসিয়া বলিল, “অ্যা! এই কথা বলেছে? ওসব তো বিলকুল ফলসো—মিথ্যে কথা। সেই মাস্টারের কাছে নিয়ে গিয়ে ভজিয়ে দেবে? তিনি কি আর বেঁচে আছেন? গেল-আগের বছর, তিনি যে হেভেন—স্বর্গে গেলেন। তাঁর শ্রাদ্ধে আমি ইনভাইট— নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছি, বেশ মনে আছে। আমাকে বড্ড ভালোবাসতেন যে। একেবারে সন ইকোয়েল—পুত্রতুল্য। তাঁর ছেলেরা আজও আমায় বেজো দাদা বলতে ইয়োরেন্ট অজ্ঞান।"

উভয় মাস্টারের পরস্পরের প্রতি এই তীব্র অপবাদ প্রয়োগের ফল এই হইল, উভয় গ্রামই স্ব-স্ব মাস্টারের অসাধারণ পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া উঠিল। অবশেষে স্থির হইল, কোনো প্রকাশ্যস্থানে দুইজনের মধ্যে বিচার হউক, কে কাহাকে পরাস্ত করিতে পারে—দেখা যাউক।

উভয় গ্রামের মাতব্বর ব্যক্তিগণ মিলিত হইয়া পরামর্শ করিলেন, উভয় গ্রামের সীমারেখার উপর যে প্রাচীন বটবৃক্ষ আছে, তাহারই নিম্নে বিচার-সভা বসিবে। কিন্তু উত্তরা গ্রামের লোকেই ইংরাজিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ । সুতরাং যাহাতে জয়-পরাজয় সম্বন্ধে কাহারও মনে কিছুমাত্র সংশয় না থাকে, এমন একটি সরল বিচার প্রণালী স্থির করা আবশ্যক। উভয় গ্রামের সম্মতিক্রমে স্থির হইল যে, মাস্টারেরা পরস্পরকে একটি ইংরাজি কথার মানে জিজ্ঞাসা করিবে, অপরকে তাহার মানে বলিতে হইবে। যদি উভয়েই বলিতে পারেন, তবে উভয় তুল্যমূল্য । একজন অন্যকে ঠকাইতে পারিলে, তিনিই জয়পত্র পাইবেন। বিচারের দিন স্থির হইল—আগামী বৈশা উপরিউক্ত বটবৃক্ষতল; সময়—সূর্যাস্ত।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.