মাস্টার মহাশয় (তৃতীয় পরিচ্ছেদ)
ধার্থদিনে সূর্যাস্তের পূর্বেই গোসাইগঞ্জের মাতব্বর ব্যক্তিগণ ব্রজ মাস্টারকে সঙ্গে লইয়া বটবৃক্ষ অভিমুখে শোভাযাত্রা করিলেন। তাঁহাদের সঙ্গে ঢাক ঢোল কাড়া নাগারা প্রভৃতি বাদ্যকরগণ আছে। এবং এক ব্যক্তি একটা বৃহৎ রামশিঙা লইয়া চলিয়াছে— ঈশ্বরেচ্ছায় যদি জয় হয়, তবে ঢাকঢোল বাজাইয়া আনন্দ করিতে করিতে গ্রামে ফিরিয়া আসিতে হইবে। পথে যাইতে যাইতে ব্রজ মাস্টারের পার্শ্ববর্তী ব্যক্তিগণ বলিতে লাগিলেন— কী হে মাস্টার, মুখ রাখতে পারবে তো? বেছে বেছে খুব শক্ত একটা কিছু ঠিক করে রাখো, হারাণ মাস্টার যেন কিছুতেই তার মানে বলতে না পারে।” ব্রজবাবু বলিলেন, "আপনারা ভাবছেন কেন? দেখুন না কী করি! এমন কোশ্চেন জিজ্ঞাসা করব যে তা শুনেই হারার মাস্টারের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে—মানে বলা তো দূরের কথা!" দত্তজা বলিলেন, "দেখো ভায়া, আজ যদি মুখ রাখতে পারো, তবে তোমার পাঁচটাকা মাইনে বাড়িয়ে দেব।”—কেহ স্পষ্ট না বলিলেও ব্রজ মাস্টার ইহা বিলক্ষণ জানিতেন যে, আজ যদি তাঁহার পরাজয় ঘটে, তবে এ-গ্রাম কলাই তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে।
সূর্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্বে গোসাইগঞ্জের দল বটবৃক্ষতলে উপনীত হইল। শপ, মাদুর, শতরঞ্চি প্রভৃতি বাহকেরা তৎপূর্বেই আনিয়া, নিজ গ্রামের সীমারেখার নিকট সেইগুলি বিছাইয়া রাখিয়াছে। দূরে পঙ্গপালের মতো নন্দীপুরবাসিগণ আসিতেছে দেখা গেল। তাহাদের সঙ্গেও শপ, মাদুর প্রভৃতি ও ঢাকঢোল ইত্যাদি আসিতেছে।
ক্রমে নন্দীপুর আসিয়া নিজ সীমানার নিকট শপ, মাদুর বিছাইয়া বসিয়া গেল। উভয় গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ সম্মুখে বসিয়াছেন, মধ্যে দুই-তিন হাত মাত্র খালি জমি। এখন প্রশ্ন উঠিল, কোন মাস্টার প্রথমে মানে জিজ্ঞাসা করিবেন। উভয় গ্রামই প্রথম জিজ্ঞাসার অধিকার দাবি করিল । কোনো পক্ষই নিজ দাবি ত্যাগ করিতে সম্মত নহে। অবশেষে বৃদ্ধগণ মীমাংসা করিয়া দিলেন, হীরু দত্ত মহাশয় একটা ছড়ি ঘুরাইয়া ঊর্ধ্বে ছুড়িয়া দিউন, ছড়ি যে-গ্রামের অভিমুখে মাথা করিয়া পড়িবে, সেই গ্রামের মাস্টার প্রথমে মানে জিজ্ঞাসা করিবার অধিকার পাইবেন।
"আমার ছড়ি লউন—আমার ছড়ি লউন” বলিয়া উভয় উভয় গ্রামের অনেকেই ছুটিয়া আসিল।
হাতের কাছে যে ছড়িটি পাইলেন, তাহা লইয়া হীরু সজোরে ঘুরাইয়া ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করিলেন । জনে ছড়ি আসিয়া ভূমিতে পতিত হইল। সকলে দেখিল, তাহার মাথাটি নন্দীপুরের দিক হেলিয়া রহিয়াছে। নন্দীপুর ইহা দেখিয়া উল্লাসে চিৎকার করিয়া উঠিল, গোঁসাইগঞ্জের মুখটি চূর্ণ হইয়া গেল। সকলে সাগ্রহে বিচার-ফলের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। নন্দীপুরের হারাণ মাস্টার তখন বুক ফুলাইয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন; ব্রজ মাস্টারও উঠিয়া পাঁড়াইলেন; তাঁহার বুকটি দুরুদুরু করিতে লাগিল, কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টায় মুখে সে-ভাবকে তিনি প্রকাশ পাইতে দিলেন না।
হারান মাষ্টার তখন বলিলেন, "আচ্ছা, বলো দেখি, এর মানে কী- HORNS OF A DILEMMA
সৌভাগ্যক্রমে ব্রজ মাস্টার এই কূটপ্রশ্নের অর্থ অবগত ছিলেন। তিনি বুক ফুলাইয়া, সহাস্য বদনে বলিলেন, "এর মানে—উভয় সঙ্কট-কেমন কিনা?” "পেরেছে— পেরেছে আমাদের মাস্টার পেরেছে” – বলিয়া গোসাইগঞ্জ তুমুল কোলাহল আরম্ভ করিয়া দিল। দলপতিগণ অনেক কষ্টে তাহাদের থামাইলেন। এখন ব্রজ মাস্টারের প্রশ্ন জিজ্ঞাসার পালা আসিল।
ব্রজ মাস্টার উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— “শোনো হারাণবাবু, আমি তোমায় কোনো কঠিন প্রশ্ন করতে চাইনে, বরং খুব সহজ দেখেই
একটা জিজ্ঞাসা করব। এ অঞ্চলে, মনে করো, তুমি আর আমি, এই দুজনে যা ইংরেজিনবিশ আছি।
একটা শক্ত কথার মানে জিজ্ঞাসা করে তোমায় ঠকিয়ে দেব, সেটা আমার মনঃপূত নয়। এতে হয়তো গোঁসাইগঞ্জ রাগ করতে পারেন কিন্তু আমি নিজে একজন ইংরেজিনবিশ হয়ে, আর-একজন ইংরেজিনবিশের প্রকাশ্যে সভায় অপমান তো করতে পারিনে। আচ্ছা, খুব সহজ একটা কথার মানে জিজ্ঞাসা করি—বেশ হেঁকে উত্তর দাও, যাতে দুই গ্রামের সকলে শুনতে পায়। আচ্ছা এর মানে কী বল দেখি- তুমি জানো নিশ্চয়ই আচ্ছা এর মানে বলো— I DONT KNOW
হারাণ মাস্টার উচ্চস্বরে বলিল--
"আমি জানি না।"
শ্রবণমাত্র নন্দীপুরের সকলের মুখ একেবারে পাংতবর্ণ ধারণ করিল। সেই মুহূর্তে গোসাইগঞ্জের দল একসঙ্গে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বিপুলবেগে নৃত্য ও চিৎকার করিতে লাগিল—" হো হো জানে না— নন্দীপুর জানে না—হেরে গেল দূও দৃত্ত।"
হারাণ মাস্টার মহাবিপন্নভাবে সকলকে কী বলিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ঠিক সেই সময় গোঁসাইগঞ্জের ঢাক ঢোল কাড়া নাগারা ও রামশিক্ষা সমবেতভাবে গর্জন করিয়া উঠিল। তাঁহার কথা আর কাহারও শ্রুতিগোচর হইবার সম্ভাবনা রহিল না।
গোঁসাইগঞ্জ-নিবাসী কয়েকজন বলশালী লোক আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে অগ্রসর হইয়া আসিল এবং অন্মধ্যে একজন ব্রজ মাস্টারকে দ্বন্ধের উপর তুলিয়া লইয়া গ্রামাভিমুখে চলিল। সকলে তাহাকে ঘিরিয়া নৃত্য করিতে করিতে, বাদ্যভাণ্ডের সহিত গ্রামে ফিরিয়া আসিল।
পরদিন শুনা গেল হারাণ মাস্টার নন্দীপুর ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। তথায় ইস্কুলটি বন্ধ হইয়া। গেল। গোঁসাইগঞ্জে ব্রজ মাস্টার অপ্রতিহত প্রভাবে মাস্টারি এবং গ্রামস্থ সকলের অপত্য নির্বিশেষে ক্ষীর ননী ছানা ভুঞ্জন করিতে লাগিলেন।
Report This Post
All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.