মারফির লঃ যা হবার তা হবেই

মারফির লঃ যা হবার তা হবেই


অফিসে যেতে আপনার যেদিন বেশি দেরি হয়ে যাবে দেখা যাবে সেদিনই আপনি দরজা লক করবার সময় চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না। তারপর অনেকটা পথ চলে আসার পরে খেয়াল হবে যে তাড়াহুড়োয় মোবাইল ফোন বা প্রয়োজনীয় ফাইল বাসাতেই ফেলে এসেছেন। এবং সচারাচল ফাঁকা থাকে এমন রাস্তাতেও সেদিন রাজ্যের জ্যাম লেগে আছে। অর্থাৎ যেভাবে যেটা হওয়ার কথা কিছুতেই সেভাবে সেটা হচ্ছে না। কিন্তু এমন ঘটনা তো আমাদের জীবনে হর হামেশাই ঘটে। তবে এরও যে কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে তা কি আপনার কখনো মনে হয়েছে? না হয়ে থাকলে মারফির সূত্রে আপনাকে স্বাগত!

মারফির সূত্রে বলে যে,

"Anything that can go wrong will go wrong."

অর্থাৎ কোন কিছু ভুল হওয়ার থাকলে তা অবশ্যই ভুল হবে। আপনি কোনো একটি কাজ করতে যাচ্ছেন এবং এতে কোনোরকম ভুল হবার সমূহর সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু কাজটি করার পর দেখা গেল যে আপনি ভুল করে ফেলেছেন। অথবা লেখালেখির খুব ভালো অভ্যাস থাকা সত্ত্বেও দেখা যাবে যে কেবল দরখাস্ত বা চিঠি লিখবার সময়ই আপনার ঘন ঘন বানান ভুল হচ্ছে। তখন আপনি আপন মনেই বলে উঠলেন শুধু কি আমার সাথেই এমনটা হতে হয়? অথচ অন্যান্য সময় যে কত সুন্দর এবং নির্ভুল উপায়ে লিখেছেন সেই ইতিবাচক দিকটিকে উপেক্ষা গেলেন। এটাই হচ্ছে মারফির সূত্রমারফির সূত্র আমাদের ইতিবাচক দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নেতিবাচক দিকে বেশি বেশি মনোযোগ স্থাপন করার বিষয়টিতে আলোকপাত করে। এবং গণিতের সম্ভাবনার সাহায্য নিয়ে বের করে যে যা হবার তা হবেই।

প্রশ্ন হচ্ছে মারফির সূত্রটি কি? আসলেই সূত্র?

Murphy's Law মারফির সূত্রটি আসলে সূত্র না ডেকে বরং দার্শনিক মতবাদ বা অনুমান হিসাবে দেখাটা বেশি যুক্তিযুক্ত। আবার এই সূত্রের উপসূত্র অসংখ্য। এমন নয় যে এই সূত্র খুব বেশি নতুন। Captain Edward Aloysius Murphy Jr থেকে এর নামকরণ হলেও এর পূর্বেও অনেক জায়গায় এর উল্লেখ ছিল। জাদুকর এদাম হল ১৯২৮ সালে তার এক প্রবন্ধে মার্ফির মতো করেই লেখেন। কোনো জাদুতে যেগুলো ভুল হবার সেগুলো ভুল হবেই। এমনকি ব্রিটেনে এটি Soft Law নামেও পরিচিত। তবে মারফির সূত্রটি আলোচিত করে তোলেন স্বয়ং Captain Edward Aloysius Murphy Jr নিজে। এ নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের গল্প। তবে যে গল্প সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য।

চলুন সেটা নিয় কথা বলি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউরোফিল এয়ার বেইসে উড়োজাহাজ নিয়ে পরীক্ষা চালানোর সময় একটি প্রকল্প গঠন করা হয়। পরীক্ষাটি ছিল গ্রাভিটি নিয়ে যে একজন পাইলটের পক্ষে একেবারে কত অভিকর্ষ তরন সামলানো সম্ভব। সহজ করে বলতে গেলে তীব্র গতিতে ছুটতে থাকা উড়োজাহাজে হুট করে ব্রেক করলে সেই প্রক্রিয়া সঞ্জত বল মানুষের পক্ষে কতদূর সহনীয় হতে পারে। সেই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন একজন ডাক্তার Captain Falstaff  আর একজন ইঞ্জিনিয়ার Captain Edward Aloysius Murphy Jr। বলের ঠিক মতো পরিমাপের জন্য Edward একজন সহকারীকে নির্দেশ দিলেন ব্র্যাকের বা বন্ধনের গায়ে একটি স্প্রিং কেস লাগাতে।

Captain Edward Aloysius Murphy Jr
Image: Captain Edward Aloysius Murphy Jr

এক শিম্পাঞ্জীকে সোয়ারী করে দ্রুত থামানোর একটি পরীক্ষাও করা হলো। কিন্তু দেখা গেল পরীক্ষার যন্ত্র কোন রিডিং এ দেখাচ্ছে না। সব চেক করে বোঝা গেল সহকারীটি রকেটস লেজের সবগুলো সেন্সর ভুল ভাবে বসিয়ে রেখেছে। রাগ আর ক্ষোভে Captain Edward Murphy মন্তব্য করেছিলেন যে

যদি একটি কাজ করার দুটি উপায় থাকে এবং এক উপায় করলে সেটি ভুল হবে। এই সহকারীটি অবশ্যই সেই উপায়ই করবে।

এর কিছু সময় পরেই Captain Edward Murphy রাইটিয়ার ফিল্ডে চলে যান কিন্তু Captain Dr Jhon Falstaff মারফির কথাটিতে একটি ভিন্ন সূত্র খুঁজে পান। পরবর্তীতে এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন মারফির সূত্র সম্পর্কে সজাগ থাকার কারণে প্রকল্প চলাকালীন তাদের দলটিকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়নি। এরপরেই এটি সাধারণ মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এবং ১৯৭০ সালে এর ওপর একটি বইও লেখা হয়। এরপর মারফির সূত্রে আরো বিভিন্ন ধারণা যোগ করে একে বর্ধিত করা হয় এখন আপনাদের মনে হতে পারে যে, এটি তো খুব সামান্য একটা উক্তি বা মতবাদ। এমনটা তো হর হামেশাই আমরা বলে থাকি।

তাহলে মারফির সূত্রটি জনপ্রিয়তা লাভ করবার বা নথিভুক্ত হয়ে থাকার পেছনে কারণটা কি?

রকেটস লেজের সেন্সরগুলোর দুটো কানেক্টেড ছিল। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা ছিল ঠিক লাগানোর। কিন্তু ভুলকে বড় করে কেন দেখা হল? সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হচ্ছে আমরা যাকে বলি অদৃষ্টের পরিণতি। ভাগ্যে যে রেখা আছে। তাই হবে। ভাগ্যের কাছে আমাদের সবকিছুই ক্ষমতাহীন। এই চিন্তাধারা আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ভাগ্যের লিখনের সাথে সাংঘর্ষিক একটি ব্যাপার হচ্ছে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা। অর্থাৎ আমরা যাই করি না কেন আমাদের প্রতিটি কাজ এবং তার ফলাফল আমরা নিজেরাই বয়ে আনি। এই দুটি ব্যাপারকে যদি আমরা একসাথে জুড়ে দিই তাহলে মারফির সূত্রের একটা ব্যাখ্যা দ্বারাই। এই সূত্র বলে যা ভুল করবার তা আমরা বারবার করবো। কিন্তু এই ভুল করার ইচ্ছাটা কিন্তু নিজেদের থেকেই আসে। অপরপক্ষে মারফির সূত্র বলে দেয় যে আমরা নিজেদের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণহীন। অফিসে যেদিন যেতে দেরি হয়ে যায় সেদিন জ্যামে পরলে আমরা নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করি।

মারফির সূত্রটি নেহায়েত মতবাদ বা অনুমান হলেও তাপ গতিবিদ্যার সাথে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে। থার্মোডাইনমিক্সের দ্বিতীয় সূত্র জগতের এনট্রপি বৃদ্ধির কথা বলে


কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা-মাত্রা সময়ের সাথে হ্রাস পায় না এবং প্রক্রিয়াসমূহ যদি এবং কেবল যদি পরিবর্তনীয় হয়, তাহলে এর মান ধ্রুব হবে। বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা ক্রমেই তাপগতিক ভারসাম্যের দিকে অগ্রসর হয় (যখন বিশৃঙ্খলা-মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে)।

অর্থাৎ, এ সূত্র থেকে সহজেই বোঝা যায়, তাপগতিক ভারসাম্যে কোন ব্যবস্থা এবং তার পরিপার্শ্বের বিশৃঙ্খলা-মাত্রা সর্বদাই ধ্রুবক হয়। কাল্পনিক পরিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও এরূপ হতে পারে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা ও এর চতুর্পার্শ্বের বিশৃঙ্খলা-মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাপগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, এ প্রক্রিয়াটি পরিবর্তনযোগ্য নয় - তবে বিশেষ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়ার এ পরিবর্তন কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে। মূলত বিশৃঙ্খলা-মাত্রার বৃদ্ধিই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অপরিবর্তনীয়তা ও অপ্রতিসমতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

Data: Wikipedia

এটা শতসিদ্ধ যে তাপশক্তিকে সহজে কাজে রূপান্তর করা যায় না। তাপশক্তিকে কাজে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন যন্ত্রের। এরকম যন্ত্র তাপইঞ্জিন নামে পরিচিত বিজ্ঞানীরা কর্ণ তাপ ইঞ্জিন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তাপকে সম্পূর্ণ কাজে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ জগতে বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকবে সেই দিক বিবেচনায় এই সূত্র সঠিক। সূত্রের মতে বাইরের শক্তির সাহায্য ছাড়া কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের পক্ষে নিম্ন তাপমাত্রার কোন বস্তু থেকে উচ্চ তাপমাত্রায় কোন বস্তুতে তাপের স্থানান্তর সম্ভব নয়। এই সূত্র ধারণা দেয় কিভাবে শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়। আর এখানেই সৃষ্টি হয় জটিলতা। আমরা কখনো এমন কিছু তৈরি করতে পারবো না যেখানে শতভাগ ইনপুট দিলে শতভাগ আউটপুট পাওয়া যাবে। অর্থাৎ কিছু শক্তি আমরা সব সময়ই হারাবো। এটিকে একটি ধারণা তৈরি হয় যে পৃথিবীর সব ব্যবস্থাতেই শক্তির বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যা প্রতিনিয়ত হচ্ছে, এটি এড়ানোর কোনো উপায় নেই।

মারফির সূত্রের গাণিতিক বিশ্লেষণও করেছেন ব্রিটিশ কালোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Biologycal Engineer Jowel Pal তার ফর্মুলা মারফির সূত্রজনিত ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা অনুমান করে কোনো সিস্টেম বা ব্যাবস্থায় ত্রুটিমুক্ত নয় তা ব্যর্থ হতে পারে। এর অর্থ সেটি পুনরায় করতে হবে। বারবার ভুল হলেও এগিয়ে যেতে হবে।

সাধারণ কিছু কথাতে মারফির সূত্র কিছু অসাধারণ কথা বলে। যেমন কোনো কাজ অতি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হতে দেখলে নিশ্চিত থাকুন কোথাও না কোথাও ভুল অবশ্যই ঘটছে। যা এখনো আপনি খেয়াল করেননি। অর্থাৎ সবকিছুই পরিপাটি মনে হয়। তাহলে ইতিমধ্যেই ভুল যা হওয়ার তা হয়ে বসে আছে। খুব দুঃখেও ভেঙে পড়বেন না। চরম শোচনীয় অবস্থা এখনো আসেনি!

প্রতিটি সমাধান থেকেই নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। যেকোনো কাজ শেষ করতে অনুমানের চেয়ে বেশি সময় লাগে। একটি পতনশীল বস্তু সর্বদাই এমন জায়গায় পতিত হবে যেখান থেকে সবচাইতে বেশি ক্ষতিসাধন সম্ভব। সবই আপনাকে মেনে নিতে হয়। হবেই। আপনি জানুন আর নাই জানুন। মারফির সূত্র তার কাজ করে চলেছে।

যেই মারফির নামে এই সূত্র তাঁর মৃত্যুর গল্পটাও তাঁরই সূত্রের অনুসরণ করেই রচিত হয়েছে। কথিত আছে গাড়ির পেট্রোল পুড়িয়ে যাওয়ায় তিনি সাদা পোশাক পরে সন্ধ্যা অন্ধকারে রাস্তার ডান দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন এক ব্রিটিশ টুরিস্ট উল্টো দিক থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে তাকে ধাক্কা মারে। বলাবাহুল্য যে ব্রিটেনে বাঁদিক ঘেঁষে গাড়ি চালানোর আইনটি আমেরিকার আইনে ভুল। আমেরিকায় ডানদিক ঘেঁষে গাড়ি চলে। আর সেদিনের চালকের সেই ভুল সংগঠিত হওয়ার ফলেই ভুলের সূত্রের জনক মারফির মৃত্যু হয়।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.