মানুষ আসলে কি চাই?

মানুষ আসলে কি চাই?


রেস্টুরেন্টের মেনু উঠছে ভয়ঙ্কর জিনিস পৃথিবীতে সম্ভবত আর নেই। ঘাবড়াবেন না দয়া করে। ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ঘটে তখন, যখন আমি কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাই। মেনুগুলো যখন আমার সামনে আসে আমি তখন এলোমেলো হয়ে যাই। এটা এমন নয় যে আমি আমার জন্য ভুল কোন মেনু অর্ডার করতে ভয় পাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে প্রতিটি খাবারের স্বাদ কেমন? তা যদি জানা যেত তাহলে নিশ্চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। সত্যি বলতে কি আমাদের জীবনটাও এমন। আমরা সবসময় নিশ্চিন্ত হতে চাই। আমরা চাই আমাদের পছন্দ আমাদের সিদ্ধান্ত গুলো যেন আমাদের বিপদে না ফেলে।

Thinking

মানুষের আমরণ তৃষ্ণা আকাঙ্ক্ষা তার আশপাশের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার। সেই দুনিয়াটাকে তার ইচ্ছে মতো সাজাতে চাই কিন্তু সবকিছু কারোর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা কোনভাবেই এই সত্যটাকে মেনে নিতে পারি না। সত্যি বলতে মানুষ নিজেকেই নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

ফ্রাইড্রের মনোবিশ্লেষকের তত্ত্বে দুটি প্রধান বিষয় আছে। তার মতে মানসিক জীবনের বেশিরভাগ অংশই ঘটে আমাদের সচেতনতার বাইরে এবং দ্বিতীয়টি ঘটে অতীতের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

বিশেষ করে শৈশব কালে অর্থাৎ আমরা আমাদের ইচ্ছার খুব সামান্য অংশই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। স্রষ্টা একমাত্র আমাদেরকেই স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দিয়ে জগতে পাঠিয়েছে। এই কারণেই আমরা যে যত উপরে পৌঁছাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার এই তাড়না তার তত বেশি বাড়তে থাকে। পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দিকে তাকালে তা আরো স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারবে। 

Child enjoy

আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে,

মানুষ তাহলে কি চায়? তার এই স্বাধীন ইচ্ছার কি কোনো সীমা, পরিসীমা নেই?

হ্যাঁ, আছে। মানুষ যুক্তি দিয়ে তার এই স্বাধীন ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। স্রষ্টা যেমন মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা দিয়েছেন। তেমনই তাকে যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এই যুক্তি বা বিবেকী মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে আমরা কেবল বিবেকহীন মানুষকেই সীমা অতিক্রম করতে দেখেছি।

একজন ব্যক্তির বিবেক জীবনের প্রথম দিকেই বিকাশ লাভ করে। যা সে শেখে তার পিতামাতা, শিক্ষক বা অন্য কারো কাছ থেকে। শৈশব মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট  এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ইচ্ছা বা আকাঙ্খা মূলত মৌলিক শারিরীক বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয়তা থেকে মানসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়।

Child care

মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম ম্যাসলো চাহিদার একটি শ্রেণীবিন্যাস মডেল। যেটাকে ম্যাসলুস, হায়রোয়ার কি অফ নিডস বলে। সেটি প্রস্তাব করেছে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য বা বাসস্থানের চাহিদা থেকে উচ্চস্তরের চাহিদা যেমন প্রেম আর সম্মানের দিকে ধাবিত হয়। এই কাঠামোটি নির্দেশ করে যে মানুষের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা এবং সৎ তৃপ্তি অর্জনের চেষ্টা করার সাথে সাথে ইচ্ছাগুলি কিভাবে বিকশিত হয়। অর্থাৎ কোন মানুষ যখন একটি পরিবারের কর্তৃত্ব লাভ করে তখন তার গোত্রের নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে। তারপর সমাজের এবং এক পর্যায়ে একটি দেশের নেতৃত্বও সে পেতে চায়। 

স্বাধীন ইচ্ছা যে সব সময় হিটলার ও মুসোলিনীদের জন্ম দিয়েছে তা কিন্তু নয়। মনোবিজ্ঞানীরা ইচ্ছাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। বলা হয়ে থাকে, 

Human desires are routed in our evolutionary history. 

অর্থাৎ 

মানুষের ইচ্ছা ব্যক্তি থেকে গোটা একটি সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে।

পৃথিবীতে যত বিপ্লব হয়েছে তার সবই ইচ্ছা শক্তির ফল। আমাদের ইচ্ছের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ যেমন আমাদের হাতে নেই তেমনি সময়ের নিয়ন্ত্রণও আমাদের হাতে নেই। সময়ের বলয় আমাদের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তবুও মানুষ সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। তা টাইম ট্রাভেলের অদম্য ইচ্ছে হোক অথবা নিজের যৌবন ধরে রাখার তাড়না। আমাদের একসময় মেনে নিতেই হয় যে প্রকৃতির বেঁধে দেওয়া এই অটোমেশনের বাইরে গিয়ে কিছু নিয়ন্ত্রণ তো অনেক দূরের কথা আমরা আমাদের গুড়িয়ে যাওয়া শরীর বা মনকেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা।

Time

সময় মানে শুধুই বর্তমান। কারণ আমাদের অতীত আর ভবিষ্যতের কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। এই মুহূর্তের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আমাদের থাকতে পারে তবে তাও দ্রুত ফসকে যাচ্ছে। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে একদিন যত নেক্রোপলিসের সন্ধান পাবেন তারা কখনো মেনে নিতে পারেনি যে তাদের সময় একদিন শেষ হয়ে যাবে।শুধু তাই নয় তাদের কেউ কেউ তাদের স্বাধীন ইচ্ছাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
সেক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয় ফারাওদের কথা আপনারা সবাই জানেন। দূর প্রাচ্যের টেরাকোটা আর্মির নেপথ্যের কারণও জানা আছে অনেকের।

ঘটনাটি চীনের। ১৯৭৪ সালে এক কৃষক একটি কুয়া খুঁড়তে গিয়ে কিছু প্রাচীন মাটির তৈরি তৈজুসপত্র খুঁজে পান। এরপর আরও খুড়তে গিয়ে সে খুঁজে পায় ২২ শত বছরের পুরনো প্রথম টেরাকোটা বা ওরা মূর্তির যোদ্ধা। তারপরে যা সামনে এলো তা রীতিমতো পুরো পৃথিবীকে হতবাক করে দিল। চীনের প্রথম সম্রাট কিংশী ওয়াং ৮ হাজারেরও বেশি এই টেরাকোটা আর্মিদের মূর্তি তৈরি করেছিলেন। চীনের একতিভূত সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট ছিলেন তিনি। বিশাল এক সাম্রাজ্যের পাশাপাশি তার রাজত্বে বেশ অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। অসীম ক্ষমতার পাশাপাশি সময়কেও পরাজিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি চেয়েছিলেন তার কোনো ইচ্ছায় অপূর্ণ থাকবে না। তিনি চেয়েছিলেন কোনোদিন মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আর এই চিন্তা তাকে অত্যাচারী বানিয়ে ছিল বিনা দোষে তিনি অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছিলেন। মৃত্যুকে খুব ভয় পেতেন তিনি।

সে বিশ্বাস করত যে যাদের সে হত্যা করেছে সেই সব মানুষের মৃত আত্মারা তার মৃত্যুর পরে প্রতিশোধ নিতে আসবে। আর এই ভয়ে সম্রাট কিঞ্চির ওয়ান তার পরবর্তী জীবনের সঙ্গ দেওয়ার জন্য টেরাকোটা আর্মি তৈরি করেছিলেন। তার এই সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পরকালে সম্রাটকে রক্ষা করা এবং তার সেবা করা। ক্ষমতার লোভে মানুষ কত অত্যাচারী হতে পারে তা একবার ভাবুন।

এবার আপনি বলুন. আপনি কি করতে চান? স্বাধীন ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান? নাকি তাকে ছুড়তে দিবেন লাগামহীন ভাবে সময়ই থামতে চান? নাকি সময়কে অতিক্রম করতে গিয়ে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে চান?


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.