পুরুষরা কেন অবহেলার স্বীকার এই সমাজে?

পুরুষরা কেন অবহেলার স্বীকার এই সমাজে?


মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে আমার যেহেতু সম্মান নাই। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অধিকার নাই। আমার মৃত্যুর দায়ভার একান্তই আমার। সরি মা। বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ।

চলে যাবার আগে চিরকুটে কথাগুলো লিখে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাজী ফিরোজ। এমন আরও অনেক চিরকুটের কথা এখানে উল্লেখ করা যাই। 

কিন্তু কেন পুরুষের কেন এত আত্ম অভিমান? 

যে অভিমান তার জীবনকে শেষ করে দেয়। পুরুষের তুলনায় নারী নাকি বেশি সহানুভূতিশীল হয়। তবে গবেষণা বলছে এই তথ্যটি পুরোপুরি সত্য নয়। ছেলেরা ছোটবেলায় মেয়েদের তুলনায় বেশি আবেগ প্রবল থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে পরিণত বয়সে পুরুষের এই আবেগ বদলে যায়, বলা ভালো চাপা পড়ে যায় সমাজ এবং জীবনের নির্মহ বাস্তবতায়।

Sad boy

পুরুষের আবেগ বোঝা যায় যখন সে প্রচন্ড চাপে পড়ে। পরিণত একজন পুরুষ তীব্র অনুভূতি প্রবন হওয়ার চেয়ে সমস্যা সমাধানে বেশি সচেষ্ট হয়ে থাকেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই ছেলেদের এই আবেগকে লুকিয়ে রাখতে শিখতে হয়। নয়তো সমাজ তাকে পুরুষত্বহীন বলে খোঁচা দেয়। কথাগুলো শুনে ধাক্কা খেলেন কি? BeeBlog Quester এর আজকের এ আয়োজন পুরুষদের নিয়ে। 

হ্যাঁ, আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি, কেমন আছেন? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন? খুব ভালো আছেন? সবকিছু ঠিকঠাক? কোন দুশ্চিন্তা বা অবসাদ আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে না? মাথার ভিতর একটা, দুইটা, অসংখ্য, অগণিত কণ্ঠস্বর ক্রমাগত আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে না? কখনো কোনদিন মনের সব কথা কাউকে কি খুলে বলতে পেরেছেন? কোন বন্ধু বা আত্মীয় বা পরিবারের কাউকে কি মন খুলে সবকিছু বলে হালকা হতে পেরেছেন? স্বভাবতই উত্তর হবে না! আর কি বলবো?কাকে বলবো? বলে লাভ কি? কেউও বুঝবে না! আর এভাবেই মুখ চেপে দিনের পর দিন আপনি এগোতে থাকবেন পুরুষ হয়ে ওঠার এক নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতায়। না না কথাগুলো বলার কারণ আপনাকে কাপুরুষ করে তোলার উদ্দেশ্যে নয়।

আমি আর আপনি যখন এই আলোচনাটা করছি ঠিক সেই মুহূর্তেই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কোনো এক যুবক হয়তো তার শেষ চিঠিটি লিখছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন পুরুষ আত্মহত্যা করে। যা নারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আর প্রতি বছর ৭ লাখেরও বেশি পুরুষ সুইসাইড করে। যাদের ৯০% ক্ষেত্রেই কারণ হলো মানসিক কষ্ট। ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই মানসিক নিষ্পেষণের কার্যক্রম মোটামুটি শুরু হয়ে যাই।

Sad boy

পুত্র সন্তানের জন্ম আমাদের সমাজে বিশাল এক আনন্দের উপলক্ষ্য। কারণ তারা মনে করে বংশ রক্ষা তো হবেই। এই পুত্র সন্তান সারা জীবন পরিবারের খুঁটি হয়ে থাকবে। বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের দায়িত্ব নেবে। বড় হয়ে অনেক অর্থ সম্পদ উপার্জন করবে। পরিবারের নাম উজ্জ্বল করবে। বয়ে আনবে গৌরব, অহংকার। আর তাই সেই সন্তান আসলে কি চায়, তার চেয়ে জরুরী হয়ে ওঠে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের চাপ। জমিজমা বিক্রি করে সেই পুত্রকে লেখাপড়া অথবা বিদেশ পাঠানোর আসল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে সে পুরো পরিবারকে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করবে। অনেক ক্ষেত্রেই বাবা মায়ের কাছে সেই সন্তান অনেকটা বিজনেস ইনভেস্টমেন্ট হয়ে ওঠে। 

আচ্ছা একটু চিন্তা করে দেখুন তো আপনি যে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন প্রায় দশ বারো বছর কেউ কি কোনদিন আপনাকে একবারও বুঝিয়ে বলেছেন যে ঠিক কেন আপনাকে স্কুলে যেতে হচ্ছে? এর আসল উদ্দেশ্য কি? এর বিপরীতে আমাদের সমাজে তো আবার প্রবাদ বাক্যের মতো শোনা যায়, 

লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চলে সে।

শিক্ষা জীবনের শুরুতেই শিশুর মস্তিষ্কে বেড়ে উঠছে অত্যন্ত লোভী ও স্বার্থপর এক সত্তা। স্কুলে আমাদের জীবনের লক্ষ্য নিয়ে রচনা মুখস্ত করানো হয়। সেখানে সকলকেই যেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে কন্ডিশন করানো হতো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে কখনো সাহায্য সাধারণত করা হয় নি।

উপমহাদেশের শিশুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে পা রাখার সাথে সাথে তাদের মাথায় খড়ক ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো হলেই সাইন্সের সাবজেক্ট নিতে হবে। মেয়েদের উপরেও যে এই চাপ নেই তা নয়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে চাপটা একটু বেশিই হয়ে থাকে।

বাবা মা যা তাদের নিজেদের জীবনে হতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তার ফলস্বরূপ তাদের সন্তানকে এখন সেটা হয়ে দেখাতে হবে। আজকাল সন্তানদের ওপরে যে পরিমান চাপ দেওয়া হয় তা রীতিমতো অমানবিক। তাদের শৈশব চুরি করে অন্যের গোলামী করার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। একই মেথডে পুরো জাতিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যার পেছনে নেই কোন সাইন্টিফিক স্টাডি। 

Sad boy

সাইকোলজিক্যালি প্রতিটি শিশু যে ভিন্ন এই সত্যটাকেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে কালের পর কাল। একটা পুরনো অচল শিক্ষা ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হচ্ছে। আবার তাকে কঠিন চাপ দেওয়া হয় ভালো রেজাল্টের জন্য। যেন প্রতিটি শিশুকেই প্রথম হতে হবে। তা নাহলে ভালো কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে সুযোগই হবে না। আর ভালো ইউনিভার্সিটি কলেজের সেরা বিষয়ে ভর্তি হতে না পারলে পুরো জীবনটাই যেন বৃথা হয়ে যাবে। 

একটা ছেলে সন্তান তার গ্রহনের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করবে অনেকে পারবে। অনেকে হয়তো আবার এই rat race এ হাপিয়ে উঠবে। পারবে না পাশের বাড়ির আন্টির ছেলের মতো Golden A+ ঘরে আনতে। কারণ প্রায়শই যোগ্যতা এবং কৃতিত্বের ক্ষেত্রে পিতা মাতারা তাদের সন্তান কর্ম ক্ষমতার তুলনা করে বসেন হয় সমবয়সী বন্ধুদের সাথে অথবা নিকট আত্মীয় বা প্রতিবেশীর সাথে।

sad boy

Academic রেজাল্ট এর রেশ কাটতে না কাটতেই আসে চাকরির পালা। খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়েও যে পেশার ক্ষেত্রে একজন ভালো করবেন তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এক্ষেত্রেও নিজের সাবজেক্ট বা পেশা নির্ধারণের ক্ষেত্রে খুব কম ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা পায় একজন ছাত্র। মানে গোড়াতেই আসলে গলদ ছিল। ফলে পেশাগত বা চাকরির ক্ষেত্রে গিয়ে একজন পুরুষের পছন্দসই কাজ খুঁজে পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। 

সমাজ শুধু টাকাকেই সফলতার মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেখানে সততা বা নীতির কোনো মূল্য নেই। যেভাবেই হোক ঘরে আনতে হবে অনেক অনেক টাকা। একজন পুরুষ মানেই একজন প্রোভাইডার। টাকা বা ক্ষমতা না থাকলে তার কোনো দাম নেই। কোনো পরিচয় নেই। আর বিয়ের বাজারেও তার কোনো মূল্য থাকবে না। টাকা পয়সা, ভালো চাকরি না থাকলে মেয়ের বাবার বাড়ি তাও অনেক পরের কথা নিজের প্রেমিকা বা বউয়ের মন জয় করতে পারাটাও অনেক দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। 

নিজের পরিবারের জন্য বাবা মায়ের জন্য স্ত্রী সন্তানের জন্য
সংগ্রাম করতে করতে মানুষটা একসময় ভুলতেই বসে যে তার নিজেরও একটা জীবন ছিল। তার নিজেরও একটু সুখ বা শান্তি পাওয়ার অধিকার ছিল। এখন তার পরিবারের সুখ শান্তি হয়ে ওঠে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তবে এই স্বীকৃতিও কখনো কখনো তার ভাঁটকে জুটে না। কারণ এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার তাই না? ওর তো জন্মই হয়েছে প্রোভাইড করার জন্য। কিন্তু সে হয়তো অফিসের ফাঁকে, একটু ওয়াসরুমে গিয়ে চাপা কান্না কেঁদে আসে। ওই যে সমাজ শিখিয়েছে পুরুষেরা কাঁদে না। কান্না পুরুষের চোখে মানায় না। তবে একজন পুরুষের জীবনের সমস্ত failure এর দায় কিন্তু একমাত্র তার নিজের।

sad boy

"মেয়েদের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস না তো! ছেলেমানুষ এত অল্পতে কষ্ট পেলে চলে নাকি?" আসলে সমস্যাটা এখানেই। অথচ প্রত্যেক মানুষেরই কিন্তু দুঃখ আছে। তবে মেয়েরা যত সহজে তাদের কষ্ট প্রকাশ করতে পারেন ছেলেরা সেটা পারে না। পারিবারিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কারণে নানান গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকে একজন পুরুষ। আটকে থাকতে হয় তাকে। নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেয়ে পুরুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অনুভূতি প্রকাশ্যে আর স্বচ্ছন্দ থাকেন না ছেলেরা।

একটা ছেলে চেষ্টা করে যায় সমাজে, পরিবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু সব সময় হয়তো তার পক্ষে এটা অর্জন করা সম্ভব হয় না অথবা প্রতিষ্ঠিত হবার নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকায় সে বুঝতেই পারে না সে আসলে সফল না ব্যর্থ? সত্যি কথা বলতে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমাজের মারাত্মক স্বীকার পুরুষেরাই। হ্যাঁ যেকোনো অসুখের ক্ষেত্রেই সহানুভূতি হতে পারে প্রথম ওষুধ। একটু সমবেদনা পারে ভেতরে ভেতরে ঢুকতে থাকা একজন মানুষকে সেই অতুল গহ্বর থেকে ফিরিয়ে আনতে।

একটা মানুষকে মন খুলে কথা বলার আশ্বাস দিতে হবে একটু বোঝার চেষ্টা করতে হবে আশেপাশের মানুষদেরকে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা আরেকটু বাড়াতে হবে। আপনার এই সামান্য উদ্যোগে কেটে যেতে পারে আপনার সন্তান, ভাই, বন্ধু কিংবা স্বামীর মনে জমে থাকা কালো মেঘ। কথা বলতে তো সবাই পারে, তাই না? মাঝে মাঝে একটু মন খুলে কথা বলতে দিন না। কিছুক্ষণের জন্য না হয় একজন শ্রোতা হয়ে যান। প্রিয়জনকে একটু একান্ত সঙ্গ দিন। একটু ধৈর্য নিয়ে একটু একটু করে আমি আপনি এগিয়ে আসলে দেখবেন। একদিন আমাদের সমাজও বদলে যাবে। নারী কিংবা পুরুষ নয় মানুষ বাঁচবে কেবলই একজন মানুষ হিসেবে।