ডেটা ব্রোকার: আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা তাদের ব্যবসার মূলধন!
প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে সময়, বদলাচ্ছে পৃথিবী, সেই সাথে বদলাচ্ছে আমাদের নানাবিধ কাজের ধরন। একটা সময় ছিল যখন কোনও কিছু কিনতে দোকানে বা বাজারে যেতে হতো। এখন আর তা না করলেও চলে। অনলাইনে অর্ডার করে দিন, কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি পৌঁছে যাবে আপনার দোরগোড়ায়।
খবর পড়া বা শোনা দরকার? অনলাইন পোর্টাল দেখুন কিংবা ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম এ খুঁজুন। ফিট থাকতে চান? আছে ফিটনেস অ্যাপ। স্টক বেচাকেনা করতে চান? অনলাইন অ্যাপ তো রয়েছেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রোলিং করতে গিয়ে কিছু একটা ভাল লাগলো? লাইক দিন শেয়ার দিন কমেন্ট করুন। কিছু ভালো লাগল না, তার জন্যও রয়েছে যথাযথ রিঅ্যাক্ট এর ব্যবস্থা।
রয়েছে টুইটারে গিয়ে আপনার অসন্তোষের কথা গোটা দুনিয়াকে জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ। নতুন রিলেশন হয়েছে? রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করুন। এ ভাবে যেন হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনটির মধ্যে ঢুকে গেছে আমাদের গোটা জীবন। আজকের কথাবার্তা হবে ডেটা চুরি নিয়ে।
একটু খেয়াল করুন তো, এই যে আমাদের জীবনের একটা বিশাল অংশ অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়ল, তার সুফল ভোগ করতে গিয়ে কত জায়গায় কত পার্সোনাল ইনফরমেশন শেয়ার করেছেন বা করছেন প্রতিদিন। এই যে আপনার আমার হাজারো পার্সোনাল ইনফরমেশন জমে আছে নাম না জানা কত প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে। এই যে আপনার ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্যের অনুমতি পেয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অচেনা একদল মানুষ। মানুষের পার্সোনাল ডেটাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি তার কতটুকু খোঁজ রাখি আমরা?
আপনার নাম, বয়স, উচ্চতা, ওজন, বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পছন্দ-অপছন্দ, ফোন নাম্বার, ইমেইল, শারীরিক অবস্থা, ক্রয়ক্ষমতা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, আপনি কাকে টেক্সট বা কল দিচ্ছেন, কোন কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছেন, কোন সুপার মার্কেট থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন এমন হাজারো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইনফরমেশন কে বলা হয় ডেটাপয়েন্ট। আর এই ডেটাপয়েন্ট গুলো খুবই মূল্যবান।
কেন? আপনার আমার মতো ছাপোষা মানুষের এত খুঁটিনাটি জানার আগ্রহ কার?
বিজ্ঞাপন দাতারা এর একটা ভাল উদাহরণ হতে পারে। এত সব ডেটা কালেক্ট করে তারা সহজেই বুঝতে পারে তাদের পণ্যের সম্ভাব্য কাস্টমার কারা। কাদেরকে টার্গেট করে মার্কেটিং চালাবে তারা।
ও আচ্ছা এই ব্যাপার কিন্তু এত শত এটা তো আমি কাউকে একবারে দিই না।
হ্যাঁ, তা কেউই দেয় না। কিন্তু নিশ্চিত থাকুন আপনার খুঁটিনাটি সব ডেটাই ইতিমধ্যে জমা হয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সার্ভারে। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে ডলারে দরদাম করে বেচাকেনা চলছে প্রতি নিয়ত। দুইশ বিলিয়ন ডলারের সুবিশাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে এই ডেটার ব্যবসাকে ঘিরে। সোজা কথায় আপনার ডেটার আপনার নেই।
এখন হয়তো গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন এর মতো টেক জায়ান্টগুলো কথা আপনার মাথায় আসছে।
না। যতদূর জানা যায় তারা আর যাই করুক আপনার ডেটা বিক্রি করে না কোথাও। বলছি এমন সব ছোট ছোট কোম্পানির কথা যাদের নাম হয়তো আপনি কোনোদিন শোনেননি আর শুনবেনও না। এমন সব কোম্পানি যারা পুরোপুরি ডেটা ব্রোকার বা তথ্য বেচাকেনার সাথে জড়িত। আর এদের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪ হাজারেরও বেশি। যারা সবার অজান্তেই সাধারণ মানুষের ডেটা সংগ্রহ করছে, বাছাই করছে। আর বিক্রি করছে চড়া দামে।
এখন ধরুন আমি সাধারণ মানুষের ডেটা হাতিয়ে তা দিয়ে বিজনেস করতে চাই। তো তার জন্য এটা তো কালেক্ট করা লাগবে নাকি? খুব কঠিন কাজ মনে হচ্ছে?
মোটেই না। প্রতিনিয়ত স্বেচ্ছায় আমাদের পার্সোনাল বিভিন্ন ইনফরমেশন আমরা শেয়ার করি অনলাইন দুনিয়ায়। কখনও মাথায় আনি না এসব যেটা দিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারে। সোশাল মিডিয়ার কথাই ধরুন, ব্যক্তিগত জীবনের কত কিছুই পাবলিকলি শেয়ার করি সেখানে। আপনি কি পেজে লাইক দিয়েছেন, কোথায় কোথায় চেক ইন দিয়েছেন, রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, ফ্রেন্ডলিস্ট আরও কত কিছু জানা যেতে পারে সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটলে।
আর শুধু কি সোশ্যাল মিডিয়া? কল রেকর্ড, জন্ম নিবন্ধন, ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য, জমি রেজিস্ট্রি - সবই বিক্রয়যোগ্য। কী? যা ভাবছেন তাই! এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা তাদের পণ্য বা সেবা বিক্রির মাধ্যমে যতটা আয় করে তার চাইতেও বেশি আয় হয়। ক্রেতার পার্সোনাল ইনফরমেশন ভিন্ন কারও কাছে বিক্রির মাধ্যমে। ইন্টারনেটে এমন হাজারো সাইট আছে যেগুলো দেখলে খুবই সাধারণ বা ফানি সাইড বলে মনে হবে। কিন্তু সেগুলোর কাজই হলো ভিজিটরদের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নেওয়া।
ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ট্র্যাকার বসিয়ে আপনার লোকেশন, কন্টাক্ট লিস্টের তথ্য জোগাড় করা খুবই আহামরি কঠিন কিছু নয়। অনেক ওয়েবসাইটে ঢুকলে দেখবেন কুকি এসেপ্ট করতে বলছে। অনেক ক্ষেত্রে এই কুকির মাধ্যমে আপনার অনলাইন কার্যক্রম ট্র্যাকিং করা হয়। কোন কোন ওয়েবসাইট আপনি ভিজিট করলেন, কোন কোন খবর আপনি পরলেন, কোন পণ্য আপনি কিনলেন অনলাইন থেকে সবই ট্র্যাক করা সম্ভব।
এগুলো কি আইনগতভাবে বৈধ?
অবশ্যই। আপনি তো শুরুতেই আই এগ্রি বাটনে ক্লিক করে বসে আছেন, কোনো কিছু না পড়েই। সম্মতিও দিয়ে দিয়েছেন Terms and Conditions বক্সে টিক চিহ্ন আপনি তো দিয়েছেন। বৈধ হবে না কেন? আপনি তো আপনার পার্সোনাল ডেটা স্বেচ্ছায় শেয়ার করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। অবৈধ হবার কোন সুযোগ আপনি তো রাখেননি।
যাইহোক ডেটা কালেক্ট করা যে কোনো ব্যাপারই না তা আশা করি পরিষ্কার। এভাবে যত ডেটা সংগ্রহ করা যাবে পরবর্তী ধাপের দিকে ততই আগানো যাবে। সেটা কিভাবে তা এবার দেখুন!
বিচ্ছিন্ন ডেটা কোনো কাজে আসবে না। এসব ডেটাকে এমন ভাবে গোছাতে হবে যেন তা দেখে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন পড়ে ফেলা যায়। প্রতিটা টার্গেট ব্যাক্তির একটা করে প্রোফাইল বানানো হয়। সেই প্রোফাইলে থাকবে তার যাবতীয় তথ্যাদি যত খাটানো গিয়েছে। আর কি এই প্রোফাইল দেখে আপনার আমার পার্সোন্যালিটি, আচরণ, মানসিক অবস্থা সবকিছুই বের করে ফেলা সম্ভব। আপনার ফেসবুক অ্যাক্টিভিটি মনিটর করে আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ধর্মীয় বিশ্বাস জেনে নেওয়া সম্ভব। অনলাইনে আপনার কেনাকাটার হিস্টোরি চেক করে আপনার পছন্দ-অপছন্দ সব বের করা সম্ভব। ধরতে গেলে সব বের করা সম্ভব যা আপনি নিজেও জানেন না।
এত শত ডেটা একত্রে করে বানানো হয় আপনার নামে প্রোফাইল। আর সেই প্রোফাইল হলো ডেটা বিজনেসের মূল প্রোডাক্ট। প্রোডাক্ট তৈরি এবার পালা বিক্রয়ের। এখন কথা হলো এই প্রোডাক্ট কিনবে কারা? প্রথম টার্গেট এই মার্কেটিং কম্পানীগুলো। আমার কাছে যদি এমন কিছু তালিকা থাকে যারা স্বাস্থ্য সচেতন, সেই তালিকা বেঁচে টাকা কামাতে পারি। যারা স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষনা করে তাদের তো দরকার এই সব তালিকা। তাছাড়া জীম ট্রেনার, রেস্তুরেন্ট আরও অনেকে রয়েছে এসকল তালিকার জন্য। যত বেশি তালিকা পাবে তত বেশি মার্কেটিং করার সুবিধা। এমন আরও কোম্পানি আছে যারা আপনার ডেটা যেন অন্য কারো হাতে না পরে তা মনিটরিং করে দিবে অর্থের বিনিময়ে। হ্যা, আপনার তথ্য আপনার কাছে রাখতে হলে আপনাকেই টাকা দিতে হবে।
এখন হয়তো ভাবছেন, তাহলে কি কিছুই করার নাই? বা এ নিয়ে মাথা গামানোর কি উচিৎ কিনা?
দেখুন মুটামুটি এখন সবার ডেটায় বেচা কেনা হচ্ছে। কাজেই এক দিক দিয়ে চিন্তা করলে এ নিয়ে মাথা গামানোর কাজ নেই। You have nothing to hide; therefore, you have nothing to fear। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কি ব্যবসা চলছে বলেই এত এত সার্ভিস ফ্রিতে পাচ্ছেন আপনি। এ দিক বিবেচনা করলে ভাবার কোনো দরকার নেই।
তবে, যদি এই তথ্য গুলো অসাধু কারো হাতে পরে যায়? তা দিয়ে যদি আপনাকে ব্ল্যাক মেইল করে অচেনা অজানা কেও? কি হবে তখন?