টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০৩

টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০৩


জুন ২০১৯ হেনোবার মেডিক্যাল স্কুলের সাইক্রিয়াটিস্ট কারস্টেন মুলার ভল তার নতুন পেশেন্ট এর মধ্যে এক অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখতে পান। এদের সবাই ছিল উঠতি বয়সী। আর সকলেই মাংসপেশির কোনো না কোনো ধরনের কম্পন বা খিঁচুনিতে আক্রান্ত ছিল। যদিও তাদের ইতোপূর্বে এমন কোনো সমস্যাই ছিল না। মুলার ভল খিঁচুনি রিলেটেড গ্লোবাল রিসার্চারদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলেন তার রোগীরা ইউনিক কিছু নয়। বিশ্বের নানা প্রান্তেই দেখা মিলেছে এ ধরনের রোগীর। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে মুলার ভল সবচাইতে অবাক হন এটা দেখে যে, এ সব রোগের বেশির ভাগই একই বুলি আওড়াচ্ছে বারবার। তা হল You are uglyঅবশেষে এই বাক্যটি এমন অদ্ভুত ঘটনার রহস্য উন্মোচনের মূল চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।

কি সেই রহস্য?

তা জানতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে জার্মানিতে। সেখানকার জ্যান জিমারম্যান নামের ২০ বছর বয়সী এক খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত যুবক শখের বশে একটি ইউটিউব চ্যানেল ও টিকটক অ্যাকাউন্ট খুলে। একজন খিঁচুনি রোগী কী ভাবে তার জীবন অতিবাহিত করে তা তার ভিডিওর মাধ্যমে জানতে পারে বিশ্বের লাখো মানুষ। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায় জিমারম্যান। ইউটিউবে দুই মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার, টিকটকে মিলিয়নের উপর ভিউ। তো এই জিমারম্যানের একটা বুলি আওড়ানোর রোগ আছে। তা হল You are ugly

কানেকশনটা ধরতে পারছেন? রিসার্চাররাও ধরতে পারলেন।

আর একটু ঘেঁটে দেখা গেল নতুন খিঁচুনি রোগীদের সবাই জিমারম্যানের ফ্যান। মুলার ভল তার রোগীদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিলেন আর তাদেরকে বোঝালেন তারা আসলে খিচুড়ি রোগী নয়। বেশিরভাগ রোগী মুলার ভলের কথাতেই সুস্থ হয়ে গেলো।

কি অদ্ভুত না পুরো ব্যাপারটা? হ্যাঁ, এই অদ্ভূত ব্যাপারটাই গভীর চিন্তার ভাঁজ ফেলল রিসার্চারদের কপালে। কী ভাবে টিকটক ভিডিওতে দেখানো অস্বাভাবিক আচরণ হাজারো সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ করে ফেলতে পারে তার সরু চেনা গেল? আজ থাকছে  তৃতীয় পর্ব।


টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০১

টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০২


এই সব উঠতি বয়সি ছেলে মেয়েদের কিন্তু জিমারম্যানের মতো কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারপরও তাদের মনে হচ্ছিল তারাও খিঁচুনি আক্রান্ত। তাও আবার সবাই প্রায় একই সাথে এমন ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত হয়েছিল। রিসার্চাররা এই অদ্ভুত খিঁচুনির নাম দেন টিকটক টিকস। এই টিকটক টিকস এর ঘটনায় একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে ছুড়ে দেয়। আজকের সময়ে সবচাইতে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া টিকটক কি অদূর ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে মানসিক সমস্যা বা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে?

Mass Psychogenic Illness বা সংক্ষেপে MPI হল এমন এক অদ্ভুত মানসিক রোগ যেখানে একাধিক লোক, একই সাথে, একই ধরনের অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি বা আচরণ করতে থাকে। যদিও তাদের এমন অদ্ভুত আচরণের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

বিশ্বাস হচ্ছে না। হ্যাঁ, বেশ অবাস্তব শোনাচ্ছে বটে। কিন্তু এমনটা সত্যি ঘটে।

মধ্যযুগের ডান্সিং প্লেগের ঘটনা সম্ভবত MPI এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ১৫১৮ সালের জুলাইয়ে স্ট্রাসবোর্গের অধিবাসীরা লাগাতার নাচতে শুরু করে কোনও কারণ ছাড়াই। শুরুটা হয় এক মহিলার মাধ্যমে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিরতি নিয়ে নিয়ে একাই নাচে সে। এরপর তার সাথে যুক্ত হয় আরও তিন ডজন মানুষ। এরা সবাই ক্রমাগত নাচছিলো। কোনোভাবেই নাচা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে পারছিল না। এরই মধ্যে শহর কর্তৃপক্ষ নিছক ঠাট্টা ছলে মিউজিশিয়ান ভাড়া করে আনলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে চলে যায়। আরও অনেক লোকে পাগল দের দলে সামিল হয়। আগস্ট নাগাদ প্রায় ৪০০ লোক এই অদ্ভুত নাচের দলে নাম লেখায়। এর মধ্যে  শ'খানেক ক্রমাগত নাচতে নাচতে অসুস্থ হয়ে মারাও যায়। এটা বেশ পুরনো ঘটনা। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাও আছে।

মেক্সিকোর এক বোর্ডিং স্কুলের এক ছাত্র পায়ে ব্যথা আর অসাড়তার সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এর পরপরই ওই স্কুলের আরও অনেক ছাত্র একই সমস্যা দেখা দেয়। পূর্ব আফ্রিকার একটি স্কুলে তিন ছাত্রী বেসামাল ভাবে হাসতে শুরু করে। পরবর্তীতে ওই স্কুলের আরও শতাধিক স্টুডেন্ট এই অনিয়ন্ত্রিত হাসি রোগে আক্রান্ত হয় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। MPI এর ধারণাটা যত অদ্ভুত শোনাক বাস্তবে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই। মূলত একই মনোভাব, মানসিক অবস্থা বা চিন্তার লোকেরাই দলবদ্ধ ভাবে MPI এর শিকার হয়।

টিকটক টিকস এর ব্যাপারটা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই? জিমারম্যান দ্বারা প্রভাবিত সেই ঘটনা রিসার্চারদের উদ্ভত্ত করে টিকটক MPI সৃষ্টি করতে পারে কি না তা নিয়ে গবেষণা চালাতে।

টিকটক মূলত জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছে প্যানডেমিক এর সময়। টুইটারের চাইতে তিনগুণ বেশি ইউজার রয়েছে টিকটকে। সাম্প্রতিক এক স্টাডি বলছে, ২০২১ সালে সবচাইতে জনপ্রিয় ডোমেন ছিল টিকটক, গুগল নয়। হ্যাঁ, জনপ্রিয়তার দিক থেকে গুগল কেও পিছনে ফেলেছে এই টিকটক। প্রতি মাসে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ টিকটক ব্যবহার করে, যারা দৈনিক গড়ে ৯৫ মিনিট সময় কাটাচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মে। এ কারণে আমাদের মস্তিষ্কে টিকটক এর প্রভাব কী রকম তা নিয়ে বিস্তর আলাপ হওয়া দরকার। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে বুলি কপচানো হচ্ছে তো বহুদিন ধরেই। কিন্তু টিকটকের ব্যাপারটা কিছুটা আলাদা। কীভাবে?

Tiktok In Brain

দেখুন টিকটক অ্যাপ ওপেন করলেই আপনি যা পাবেন তা হল For You পেজ। যেখানে আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারে এমন সব ভিডিও একের পর এক সাজানো থাকে। কোনটা ভালো লাগল না স্ক্রল করে পরেরটায় চলে যান সেটা ভালো না লাগলে তার পরেরটা বা তার পরেরটা। স্ক্রল কিন্তু শেষ হয় না কখনোই। এসব ভিডিও ছোট হয়। ক্রমাগত এসব ছোট ভিডিও দেখতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে তখন পাঁচ মিনিটের একটা ইন্টারেষ্টিং ভিডিও দেখতেও বিরক্ত লাগেকারণ কী বলুন তো? মনোযোগের অভাবক্রমাগত অল্পতেই আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা থাকায় আপনার মস্তিষ্ক অতক্ষণ ধরে রাখতে চায় না। এভাবে টিকটক এর প্রভাবে ধৈর্য আর মনোযোগ কমতে থাকে আশঙ্কাজনক হারে। ফলাফল পড়াশোনায় ব্যাঘাত, কমিউনিকেশন প্রবলেম, ঘরকুনো হয়ে থাকার প্রবণতা, রিলেশনশিপে সমস্যা, দুশ্চিন্তা, হতাশা আরও কত কী?

Tiktok Effect

Curtin University এর এক সাম্প্রতিক স্টাডিতে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যাদের মনোযোগ কম তাদের উপর আর মনোযোগ কমাতে টিকটকে জুড়ে আর কে আছে বলুন? টিকটক টিকস এর ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটাই ঘটছে। এবং এটাই হয়তো টিকটক সম্পর্কিত প্রথম কোনো মানসিক সমস্যা যা বৃহৎ পরিসরে সবার সামনে এসেছে। অমনোযোগের ফলে নিজের অজান্তেই বিভিন্ন অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করছে টিকটকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েগুলো। জিমারম্যান এর সাথে সম্পর্কিত ওই আশ্চর্যজনক ঘটনার পেছনের কারণও এই।

Tiktok Effect

জিমারম্যানের উদ্দেশ্য কিন্তু কোনও ভাবেই তার খিঁচুনি বা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি কে প্রোমোট করা ছিল না। কিন্তু তার এই খিঁচুনি আর অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গির ফলে কোমলমতি কিশোরদের মনে একটা সহানুভূতির জায়গা করে নিতে সময় লাগেনি। তার ফলে রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেছে সে। টিকটক এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী খিঁচুনি সম্পর্কিত ভিডিওর ভিউ পাঁচ বিলিয়নেরও বেশি। ভাবতে পারেন? এ কারণে কমবয়সি ছেলেমেয়েরা ভেবে নিয়েছে এমন অঙ্গভঙ্গি করলে অন্যদের চাইতে আলাদা হওয়া যায়। মানুষের অ্যাটেনশন পাওয়া যায়, সহানুভূতি পাওয়া যায়, ভাইরাল হওয়া যায়। লো অ্যাটেনশন স্প্যান এর কারণে নিজেদের অজান্তেই জিমারম্যানের অনুকরণ করতে করতে তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা। ফলাফল এই MPI।

MPI ব্যাপারটা নতুন কিছু। শত বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় এমন নানা ঘটনা। কেন এমন ঘটে তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। তাই এই অদ্ভুত মানসিক রোগের রহস্য আজও রহস্যই রয়ে গেছে। তবে টিকটক টিকস সেই ঘটনা থেকে বোঝা যায় আমাদের কিশোরদের উপর টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াগুলির প্রভাব কতখানি। তা এতটাই যে এগুলো MPI কে উস্কে দিতে সক্ষম। পরিশেষে কয়েক সেকেন্ডের উদ্ভট নাচের ভিডিও বা ঘোড়ার গোবর পরিষ্কার করার ১৫ সেকেন্ডের ক্লিপ না দেখে আমাদের ব্লগ প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।


Report This Post

All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.