টিকটক কি সমাজকে ধ্বংস করছে? পর্ব-০১
টিকটক ভিডিও বানানো নিয়ে কলহের জেরে বাগেরহাটে স্ত্রীকে হত্যা করেছে এক স্বামী।
সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে টিকটক মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে ডেকে আনা হয় তার বাড়িতে। টানা তিনদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয় তাঁকে।
২০২০ এর ডিসেম্বরে এক পড়ন্ত বিকেলের শীতের আবহাওয়া বেশ জাঁকিয়ে বসেছে গোটা গাজীপুরে। নানার বাসায় যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বেরোল এক কিশোরী। কতই বা বয়স! এই ধরুন ১২-১৩ হবে। নিজের বাড়ি থেকে তার নানার বাসা মাত্র ২ মিনিট। একাই রওনা দিলেন সে। কথা ছিলো সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল ঠিকই মেয়েটি আর বাড়ি ফিরছে না। শুরু হল খোঁজাখুঁজি। জানা গেল সে তার নানার বাসায় যায়নি। তাহলে গেল কোথায়? এক পর্যায়ে বাবা মা দ্বারস্থ হন পুলিশের। থানায় জিডি করা হয়। তার দিন তিনেক পর রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়, মেয়েটির শখের বসে টিকটকে ভিডিও বানাতো। এর মাধ্যমে তার সাথে পরিচয় হয় শিশির, শাওন, জুনায়েত এর সাথে। যারা তাকে দেখায় টিকটক স্টার হওয়ার মিথ্যা প্রলোভনের। রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে মিথ্যে অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয় মেয়েটি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। সেখানে একটি কক্ষে আটকে রেখে তাঁকে গনধর্ষণ করা হয়। চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। পরবর্তীতে উদ্ধার হওয়ার পর মেয়েটির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম।
In future, Everyone will be famous for 15 minutes.
কথাটি আমেরিকান আর্টিস্ট এন্ডি ওয়ারহল এর। জনপ্রিয় আজকাল কে না হতে চায় বলুন! মানুষ মাত্রই স্বীকৃতি আর প্রশংসার কাঙ্গাল। সবাই চায় ইন্টারনেটের দুনিয়ায় মানুষ তাঁকে চিনুক-জানুক, তার কদর করুক। আর ইন্টারনেটে রাতারাতি ফেমাস হতে টিকটক এর জুড়ি নেই। একেবারে অচেনা অজানা নিতান্তই সাধারণ কারো ভিডিওতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে লাখ লাখ ভিউ, লাইক, শেয়ার। সেখান থেকে পপুলারিটি বাড়তে বাড়তে রীতিমতো সেলিব্রিটি বনে যায়।
হ্যাঁ, টিকটক থেকে অর্থ উপার্জন হয় এটা সত্যি। তবে ভাবুন তো কয়জন টিকটকারকে আপনি চেনেন যার অর্থ উপার্জনের জন্য টিকটকে কন্টেন্ট বানাচ্ছে? মূলত অর্থ নয় বরংনিজেকে প্রচারের জন্যেই টিকটকের বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান নিয়ামক। অমুক টিকটক সেলিব্রিটি শুনেছেন হয়তো। এই মুহূর্তে কয়েকজন টিকটক স্টারের নাম মাথায় আসছে আপনার। তাই না? কিন্তু কথা হচ্ছে এই ফেমাস হওয়া বা সেলিব্রিটি বনে যাওয়ার impact কি? টিকটকের এই লাগামহীন পাগলা ঘোড়া আমাদের সমাজকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে?
আচ্ছা, পজিটিভ impact দিয়ে শুরু করা যাক। করোনায় মহামারির lockdown এ মানুষের জীবন হয়ে গেছে একঘেয়ে। দুর্বিষহ, একাকীত্ব গ্রাস করে ফেলেছে অনেককে। ফলে অনেকেই নিতান্ত সময় কাটানোর জন্য হাতের স্মার্টফোনটিতে ইনস্টল করছেন টিকটক, খুলেছেন অ্যাকাউন্ট, বানাচ্ছেন কনটেন্ট। দিব্যি কেটে যাচ্ছে সময়। অবশ্য এটাকে পুরোপুরি পজিটিভলি নেওয়া যায় কি না তা কিন্তু তর্কসাপেক্ষ। তবে এর বাইরেও পজিটিভ দিক রয়েছে। বিশাল এক কমিউনিটির সাথে মুহূর্তে কানেক্ট করা যাচ্ছে। এর মধ্যে কেউ হয়ত খুব সুন্দর গান গাইতে চান। আবার কেউ হয়তো ছবি আঁকাতে অসম্ভব পারদর্শী। তাঁদের এই সুপ্ত প্রতিভা বাইরের দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে চাইলে টিকটক এর চেয়ে ভাল প্ল্যাটফর্ম আর কী আছে বলুন?
সম্প্রতি মানুষের মুখে মুখে Pasoori গানটা শুনেছেন না? গানটির গায়িকা Shae Gill অসাধারণ গায়কি সর্বপ্রথম সবার নজরে এসেছিল কিন্তু সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে। এ ছাড়া বিভিন্ন ছোট ছোট অর্গানাইজেশন বা স্টার্টআপ এর প্রমোশনের একটা সহজ সুযোগ তৈরি হয়েছে টিকটকের সুবাদেই। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা পাচ্ছে বিরাট এক মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম। তবে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে রাতারাতি ফেমাস হওয়ার ভাল দিকের চেয়ে খারাপ দিকটাই বেশী প্রকট। ভাইরাল হবার রীতিমত এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে টিকটকে। সবাই ছুটছে ভাইরাল হওয়ার পেছনে। আর তার জন্য অনেকে বিভিন্ন সস্তা কুরুচিপূর্ণ ট্রোল ভিডিও, অশ্লীল কার্যকলাপ, উদ্ভট বিকৃত অঙ্গভঙ্গির নাচ, গান, অপসংস্কৃতির অনুসরণ সবই চলছে এখানে।
এর কারণ কি জানেন?
সুস্থ সুন্দর কনটেন্টের চেয়ে অসুস্থ মানহীন কন্টেন্ট প্রচার বেশি। আর এসব কনটেন্ট নির্মাতা তো চাই ভাইরাল হতে। আর সেটা যে উপায়েই হোক। এভাবে ভাইরাল হবার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শামিল হচ্ছে অনেকে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীরা। এটা যে কতটা সুদূরপ্রসার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে আমাদের সমাজে তা কিন্তু কল্পনার বাহিরেই। আজকাল ভাইরাল হতে কিন্তু প্রতিভা লাগে না। ওই যে বললাম মানহীন কন্টেন্ট প্রচার বেশি। ফলে মেধা মননের চর্চায় গুরুত্ব কমেছে ভাইরাল হওয়ার নেশায় বিভোর হয়ে। অনেকেই নিজের অমিত সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে।
কোনো একটা টপিক ট্রেন্ডে থাকা অবস্থাতেই তা নিয়ে ভিডিও না বানাতে পারলে তো তাদের ভাইরালের লিস্টে নাম উঠবে না। এভাবে ট্রেন্ড ফলো করতে গিয়ে সত্যিকারের প্রোডাক্টিভ কাজের কোনও খবর নেই। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পড়াশোনা, কাজকর্মে। কিশোর কিশোরীদের সুষ্ঠ মানসিক বিকাশেও পড়ছে বাধা। যে বয়স তাকে হুমায়ূন আহমেদ, শরৎচন্দ্র এর গল্পে মুখ ডুবিয়ে থাকার কথা। কিংবা ফুটবল নিয়ে কাদা মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার কথা, সেই বয়স তাতে তাঁরা উদ্ভট, রংচঙে হেয়ার স্টাইল করে টিকটকে সস্তা পাবলিসিটি পেতে চাচ্ছে। এমনকি অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বানাতেও দ্বিধা করছেন না অনেকেই। এ ভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে অশ্লীলতা। ঘুরছে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়।
তাছাড়া বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ টিকটকের ট্রেন্ডিং হচ্ছে প্রায়। সকল চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে বড়সড় অঘটন বা দুর্ঘটনার শিকার হয় অনেকে। তবে টিকটকের ক্ষতিকর দিকটা যে শুধু ভাইরাল হওয়ার নেশাতেই ঘিরে ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে টিকটককে কেন্দ্র করে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টা চোখে পড়ার মত। এসব কিশোর গ্যাং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে মারামারি ছিনতাই, চুরি এমনকি মানুষ হত্যার মত ঘটনা ঘটিয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ত হয়ে অনেকেই হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। বিনোদন কেন্দ্রগুলো যেন টিকটক কিশোর গ্যাংদের স্বর্গরাজ্য। এছাড়া ফুটপাত দখল করে দলবেঁধে ভিডিও করা। এমনকি ভিডিও করার জন্য রাস্তার গাড়ি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করাও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি টিকটকের মাধ্যমে পরকীয়ার খবরও আজকাল শুনতে পাওয়া যায়। টিকটককে ঘিরে পরিবারে অশান্তি, ডিভোর্স এমনকি স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর খুনের মতো ভয়াবহ ব্যাপার ঘটেছে। শুরুতেই বলেছিলাম, বেশিরভাগ মানুষের টিকটক কনটেন্ট বানানোর মুখ্য উদ্দেশ্য তারকা খ্যাতি পাওয়া।
তবে কি সবাই ফেমাস হয়ে যায়? নিশ্চয়ই না। অনেকে সোনার হরিণের পেছনে ছুটলে ও তাকে ধরতে পারে হাতেগোনা কিছু মানুষ। তাহলে বাকিরা?
হ্যাঁ, এমন অনেকেই আছে যারা একটু পরিচিতি লাভের আশায় ভিডিও করছে ঠিকই কিন্তু আশা পূরণ হয়না। একের পর এক ভিডিও বানানোর পর মেয়েটি যখন দেখে তার ভিডিও রিচ পাচ্ছে না, তাঁর বান্ধবীর ফ্রেমের কাছে কিছুই না। তখন হতাশার কালো মেঘে ছেয়ে যায় মনের আকাশ। শুরু হয় নিজেকে জাজ করা। সেখান থেকেই আসে হীনমন্যতা। এজন্য দেখবেন ভিডিওতে লাইকের জন্য কাকুতিমিনতি করে অনেকে। যেন লাইক না পেলে জীবনটাই বৃথা। অনেকেই আবার কন্টেন্ট আপলোডের পর উল্টো ট্রোলের শিকার হয়। তাদেরও মানসিক অবস্থা হয়ে যায় আরও শোচনীয়।
তবে উল্টো ব্যাপারও ঘটে। নিজেকে প্রচার করতে গিয়ে আধিপত্যকামী মনোভাব সৃষ্টি হয় অনেকের মধ্যে। আমি অমুক, আমি তমুক, তুই আমার চেয়ে বেশি বুঝিস - এই অন্তঃসারশূন্য হামবড়া মনোভাবেরই impact পরছে আমাদের সমাজে। কমছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর অন্যের মতামতের প্রতি সহনশীলতা। ফলে সমাজে বাড়ছে অশান্তি, বাড়ছে সহিংসতা।
এতো গেল টিকটক কনটেন্ট বানানোর নানা দিকের আলাপ। টিকটকের আর কি কোনও নেগেটিভ সাইড নেই? ভুরি ভুরি আছে। টিকটকের randomly scroll করে যাচ্ছেন আর ভিডিও দেখছেন মাঝখান থেকে আড়াই ঘণ্টা হওয়া হয়ে যাচ্ছে। এমনটা ভেবে দেখেছেন কেন এমনটা হয়? কখনও খেয়াল করে দেখেছেন কি রাত একটু বেশি হলে যৌন আবেদনময় কনটেন্ট স্ক্রিন একটু বেশি আসতে থাকে? শুনেছেন ফিলিস্তিনে নির্যাতিত অসহায় মানুষের সাপোর্টে কনটেন্ট বানালে অ্যাকাউন্ট ব্যান হয়ে যাওয়ার গল্প? হ্যাঁ, এসব গল্প না হয় আজকের মতো থাক। এসব নিয়ে কথা হবে দ্বিতীয় পর্বে।
Report This Post
All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.