কোচিং সেন্টার নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান!

কোচিং সেন্টার নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান!


বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। স্কুল ব্যাগ কাঁধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে এক কিশোর। নাম রোহান। সেই কোন সকাল বেলায় স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে বাড়ি থেকে। স্কুল শেষ করে দৌড়াতে হয়েছে কোচিংয়ে। সেখানে টানা পড়া শেষ করে যখন বাড়িতে পৌঁছালো রোহান তখন পাখিরা নীড়ে ফিরছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের ধ্বনি। খেতে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বই নিয়ে বসতে হবে। না হলে মা বকবেন। ভালো লাগে না রোহানের। শুক্রবারের জন্য হাঁসফাঁস করে তার দুর্দান্ত কিশোর মন। ওই দিনটাতেই শুধু কোচিং থাকে না তার। বিকালে খেলাধুলা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডার কিছুটা সময় পাওয়া যায়। এর বাইরে তাঁর সপ্তাহের বাকি ছয় টা বিকেল কাটে কোচিংয়ে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় মাঝে মাঝে। ইস, কোচিংটা যদি না করা লাগত! কিন্তু না করেইবা উপায় কি? স্কুলে অনেক স্যারই ঠিকমতো ক্লাস নেন না, পড়া বোঝান না। আর তাছাড়া অন্য অনেকেই তো করে। মা বলেন, কোচিং না করলেও অন্যদের চাইতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই কি আর করা? বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় গুঁজে সব মেনে নেয় রোহান।

প্রিয় পাঠক এতক্ষণ যে রোহানের গল্প আপনারা জানলেন তার বাস্তব অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না তা নিয়ে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। কিন্তু আপনার মনে নিশ্চয়ই এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, আমাদের চারপাশে এমন রোহান রয়েছে অগণিত।

Student Overload

স্কুল বা কলেজের রেগুলার ক্লাসের বাইরে কোচিং করে না বা প্রাইভেট পড়ে না এমন ছাত্র খুঁজে পাওয়ার চাইতে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার ঢের সহজ কাজ। কোচিং করা বা প্রাইভেট পড়া রীতিমতো এক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে আমাদের সমাজে। শিক্ষা বিষয়ক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এডুকেশনাল কমিউনিকেশন বা এসির ২০১৭ সালের হিসাব মতে, দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ৭৭.০৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে মূল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থের বিনিময়ে কোচিং নিচ্ছে। তাদের মতে, দেশ জুড়ে ছোট বড় মিলিয়ে কোচিং সেন্টার রয়েছে প্রায় ১,৭৫,০০০

আর এখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব কোচিং সেন্টারগুলোতে বছরে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ কত জানেন? ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা। হ্যাঁ, ভুল কিছু শোনেনি মোটেই। শিক্ষাকে পুঁজি করেই হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের আদ্যোপান্তই থাকছে BeeBlog Quester এর আজকের প্রতিবেদনে।

Overload Student

মানব সৃষ্টির সূচনা থেকেই মানুষের জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা শুরু। কিন্তু মানব বসতির শুরুতে মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম। এবং তখন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। মানুষের কাছ থেকে মানুষ শিক্ষিত। এবং একজন যা জানত তা অপরজনকে শেখাতো। তখন প্রত্যেকেই ছিল শিক্ষক ও প্রত্যেকেই ছাত্র। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় আর মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কালের পরিক্রমায় জ্ঞান অর্জনের জন্য দেশে দেশে গড়ে উঠতে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারই ধারাবাহিকতায় জ্ঞান অর্জনের জন্য আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে হাজারো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা অর্জনের প্রধান মাধ্যম হলেও আজকাল এসবের বাইরেও যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার।

Overload Student

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। কয়েক দশক আগেও স্কুল কলেজের শিক্ষকরাই কেবল প্রাইভেট পড়াতেন। এর বাইরে তেমন কোনো কোচিং সেন্টার ছিল না। কিন্তু এখন স্কুল কলেজের শিক্ষকের বাইরে অনেকেই কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবক এখন কোচিং সেন্টার পরিচালনাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে। স্কুল কলেজের বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে সব কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। সেখানে ক্লাস করে এবং পরীক্ষা পাশের প্রস্তুতি নেয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি কোচিং থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের বিভিন্ন ক্লাস, এর একাডেমিক কোচিং, BCS, Bank Job , IELTS, GRE প্রিপারেশন কোচিং কোনটা চাই আপনার?

সবই আছে। আর থাকবে নাই বা কেন? কোচিং সেন্টারের চাহিদা তো অনেক। ঘরে ঘরে শিক্ষার্থী আজ কোচিংমুখী। কিন্তু কেন এই হাল? কেন কোচিংয়ের দিকে এত বেশি ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা?

এই প্রশ্নের উত্তর কমবেশি সবারই জানা। একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। স্কুল কলেজে ভাল ক্লাস হয় না, স্যার ক্লাসে কী পড়ান তা ঠিক মতো বুঝতে পারি না - মোটামুটি এ সব উত্তরই আসবে ঘুরে ফিরে। আর অভিভাবকরা কী বলছে অমুকের ছেলে কোচিং করে, তমুকের মেয়ে ব্যাচে যায়। আমার সন্তানকেও না দিয়ে কী ভাবে?

Overload Student

মূলত কোচিং ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সফল ভাবে এদেশের অভিভাবকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, স্কুল, কলেজে লেখাপড়া পরিপূর্ণ নয়। এর সঙ্গে যে ভাবে হোক যতখানি সম্ভব, কোচিংয়ে স্পর্শ থাকতে হবে। এখন অভিভাবকরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। যেহেতু সবার ছেলেমেয়ে কোচিং করছে তাই যদি নিজের ছেলেমেয়েদের কোচিং করতে দেওয়া না হয়, তাহলে যেন কোন এক ধরনের অপরাধ করা হয়ে যাবে। সেই অপরাধের কারণে তাঁদের ছেলেমেয়েদের কোনও একটা ক্ষতি হয়ে গেলে তাঁরা কখনোই নিজেদের ক্ষমা করতে পারবেন না। সে জন্য ভাল হচ্ছে না মন্দ হচ্ছে সেটা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। নিজের ছেলেমেয়েদের চোখ বন্ধ করে কোচিং করতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। অথচ এসব শিক্ষার্থীরা যদি একটুখানি সাহস করে কোনও কোচিং ব্যবসায়ীর কাছে না গিয়ে নিজেরা নিজেদের পড়া করত, তাহলে হয়তো তাঁদের জীবনটা হতো অন্য রকম। তাদের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের জন্ম হতো। লেখাপড়া করার বাইরে তাদের প্রচুর সময় থাকত। যে সময়টিতে তারা গল্পের বই পড়তে পারত, ছবি আঁকতে পারত, গান গাইতে পারত, বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে পারত। এখন তারা স্কুল শেষে এক কোচিং থেকে অন্য কোচিং ছুটে যায়। তাদের জীবনে বিন্দুমাত্র অবসর নেই। ঠিক শুরুর দিকে বলা রোহানের মতো।

Overload Student

লেখাপড়া একটা বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে  শিক্ষা। কাজেই আমরা সবাই চাই আমাদের ছেলে মেয়েরা শিখুক। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। কী শিখছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে কী ভাবে শিখছে। কারণ একজনকে কোচিং করিয়ে কিছু একটা শিখিয়ে দেওয়া হয়তো সম্ভব। কিন্তু একবার শিখলে তো বিষয়টা শেষ হয়ে যায় না। একজন মানুষকে সারা জীবন শিখতে হয়। কাজে নিজে নিজে শিখতে পারে সে সারাটা জীবন শিখতে পারবে।

একটা  কথা আছে,

কাউকে একটা মাছ কিনে দিলে সেদিনই সে মাছ খেতে পারে। কিন্তু তাকে মাছ ধরা শিখিয়ে দিলে সে সারাটা জীবন মাছ ধরে খেতে পারবে।

শিক্ষার বেলাতেও এটাই সত্যি। কোচিং করে কাউকে কিছু একটা শিখিয়ে দিলে সে বিষয়টি শিখতে পারে। কিন্তু কী ভাবে শিখতে হয় সেটা জানিয়ে দিলে সারা জীবন শিখতে পারত। কিন্তু আমাদের কোচিং সেন্টার গুলোতে বিভিন্ন নোটশিট, টোটকা বানিয়ে রেডিমেড গিলিয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আর সে সব রেডিমেড পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে ঠিকই। কিন্তু তারা হয়ে পড়ছে পরনির্ভরকিন্তু এমনটা কী আমরা চাই? আমরা তো চাই আমাদের ছেলেমেয়েদের ভেতর সেই আত্মবিশ্বাসটুকু গড়ে উঠুক যে, কোনো রকম কোচিং ছাড়া তারা নিজেরাই নতুন কিছু শিখতে পারবে। তথ্যপ্রযুক্তি বলি কিংবা অটোমেশন বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সই বলি না কেন? খুবই দ্রুত এগুলো পৃথিবীর মানুষের জায়গা দখল করে নিতে থাকবে। আমরা চাই আমাদের দেশের ছেলে মেয়েগুলো আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল মানুষ হিসেবে বড় হোক। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কোনো একটি যন্ত্র এসে যেন তাদের অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে না পারে।

AI VS HUMAN

এছাড়াও কোচিং বাণিজ্যের অবাধ প্রসার এর ফলে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এর প্রতিকার স্বরূপ এখন কোনও পাবলিক পরীক্ষার আগে সকল কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হয়। তবু প্রশ্ন ফাঁস পুরোপুরি ঠেকানো যাচ্ছে না। অনেক কোচিং সেন্টারে সন্তানকে ভর্তি করাতে অভিভাবককে গুনতে হয় চড়া অঙ্কের অর্থ। যা সমাজের নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য অসম্ভবই বলা চলে। এ ভাবে শিক্ষার মতো একটি মৌলিক চাহিদাতেও বৈষম্যের ছাপ প্রকট করে তুলেছে কোচিং ব্যবসা। অনেক স্কুল কলেজের অসাধু শিক্ষক তার ব্যাচ বা কোচিংয়ে না পরলে শিক্ষার্থীদের অহেতুক হয়রানি করে থাকেন। ইচ্ছাকৃতভাবে নাম্বার কমিয়ে দেন। এ ভাবে কর গুনে গুনে বলা শুরু করলে এই ব্যবসার অন্ধকার জগতের আরও অনেক ব্যাপারে হয়তো উঠে আসবে।

কিন্তু আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে কোচিং খারাপ তা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু স্কুল কলেজে ঠিক মতো পড়াশুনা হয় না এটা তো সত্যি।

হ্যাঁ, তা মানছি অনেক স্কুল কলেজেই তা হয় না। কিন্তু কোচিং সেন্টার এই সমস্যার সমাধান নয়। বরং এই কোচিং সংস্কৃতি আমাদের স্কুল কলেজের এই দুরবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। কোচিং বাণিজ্য বলতে কিছুই যদি না থাকত তাহলে স্কুল কলেজের পড়াশোনার মান খানিকটা হলেও বাড়ত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজ থেকে শিখতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ত। কিন্তু তা হচ্ছে কই?  

Collect from তথ্যচিত্র (Youtube Channel)