কোকা-কোলার কালো রহস্য!
জীবনে অন্তত একবার কোকা-কোলার বোতলে চুমুক দেন নি কিংবা নিদেনপক্ষে নাম শোনেন নি এমন লোক এর জুড়ি মেলা ভার। স্বচ্ছ কাঁচ বা প্লাস্টিকের বোতলে পুরনো লাল রঙের কোমল পানীয়ের জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরকে একটু চাঙ্গা করতে বড়সড় অথবা ভুরিভোজের পর কোকা-কোলার চেয়ে ভালো সঙ্গ আর কেই বা দিতে পারে। বিশ্বের যে প্রান্তেই আপনি যান না কেন রকমারি দোকানগুলোতে এর দেখা আপনি পাবেন। এমনকি পৃথিবীর বাইরে মহাকাশেও নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে এই কোকা-কোলা। কিন্তু এই লাল লোহিত বর্ণের এই পানীয়র পেছনের গল্পটা জানেন কি?
কোকা-কোলার আবিষ্কার একজন পাড় মাতালের হাত ধরে।
কি চমকে উঠলেন? এতেই যদি চমকে যান, তাহলে চমকের আরও অনেক কিছু এখনও বাকি!
একটা মাতালের হাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি কীভাবে আজকের মাল্টি বিলিওনিয়ার কোম্পানিতে পরিণত হলো তা এক অপার বিস্মইয়ের গল্প। ১৮৬৫ এর এপ্রিলে কোনো এক মলিন সন্ধ্যা। আমেরিকা জুড়ে তখন ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। জর্জিয়ার কলম্বাসে যুদ্ধের ময়দানে গুরুতর আহত হলেন এক কর্নেল। নাম জন পেম্বারটন। তিনি একজন ফার্মাসিস্ট ছিলেন। মারাত্মকভাবে জখম হওয়ার পর ডাক্তার তাকে উচ্চ ডোজের মরফিন দিলেন, যেন জীবনসায়াহ্নের সন্ধিক্ষণে সময়টা একটু শান্তিতে থাকতে পারেন। কিন্তু স্রষ্টার ডায়েরিতে যে অন্য কিছু লেখা ছিলো। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। তবে যে মরফিন তাকে ব্যথানাশক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, সে মরফিনে আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি।
যখন দেখলেন, নেশা ছাড়তে পারছেন না তখন প্রায় এক দশক ধরে মরফিনের বিকল্প কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে লাগলেন এই ফার্মাসিস্ট। এক সময় সফল হন তিনি। ১৮৮৫ সালে নিয়ে আসেন এক টনিক, যার নাম Pemberton French Wine Coca। এটি তৈরি হতো Coca Leaves এবং Kola Nut এর সমন্বয়ে।
The cocaine alkaloid content of dry Erythroxylum coca var. coca leaves was measured ranging from 0.23% to 0.96%.
The kola nut is a caffeine-containing nut of evergreen trees of the genus Cola, primarily of the species Cola acuminata and Cola nitida.
Source: Wikipedia
শুরুতে সিরাপের শিশিতে করে এই টনিক বিক্রি হতো ফার্মেসিতে। বলা হতো, এটি বদহজম, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মাথাব্যথা, মরফিন আসক্তি এমনকী পুরুষত্বহীনতার মতো সমস্যাও নিরাময় করে। অন্তত পেম্বারটন এমনটাই দাবি করতেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বাধল বিপত্তি। ১৮৮৬ তে জর্জিয়ায় নিষিদ্ধ হলো অ্যালকোহল। এখন উপায়?
উপায় অবশ্য একটা বের করে ফেললেন এই মাতাল ফার্মাসিস্ট। তার আবিষ্কৃত আগের ফর্মুলা থেকে এখন সরিয়ে ফেললেন। সাথে যোগ করলেন Carbonated Water আর একগাদা চিনি। তা ধরুন প্রায় প্রতি গ্যালোন সিরাপে পাঁচ পাউন্ডের বেশি। কিন্তু পেম্বারটনের ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিল না। এই নতুন রেসিপি খুব একটা ছিল না। বাজারে প্রথম বছরে মাত্র ৬০০ গ্যালোন সিরাপ বিক্রি হলো।
নিদারুণ কষ্ট এবং শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে বাধ্য হয়ে মাত্র ২৩০০ ডলারে এবং কোকা-কোলা স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন আরেক ফার্মাসিস্ট Asa Griggs Candler কাছে। তার কিছুদিন পরেই মারা যান পেম্বারটন। নিজের আবিষ্কৃত পানীয়ের জনপ্রিয়তার ছিটেফোঁটা দেখতে যাওয়ার মতো চাঁদ কপাল হয়নি তার। তবে Candler ছিলেন চালাক। তিনি বুঝতে পারলেন ঘাপলা রেসিপিতে নয়। অভাব ছিল প্রচারের প্রচারে। সেদিকেই মন দিলেন তিনি।
আটলান্টা ছুঁয়ে ফেললেন কোকা-কোলার লোগো দিয়ে। বাড়ির দেওয়াল থেকে মানিব্যাগ, খবরের কাগজ থেকে ক্যালেন্ডার বাদ যাবে না কোনো কিছু। তবে তাতেও ভাগ্য সহায় হলো না। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন Candler। এবার আশেপাশের প্রতিটা বড় ফার্মের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বড় বড় খদ্দের লিস্ট জোগাড় করলেন। এরপর প্রতিটা খদ্দেরকে এক গ্লাস ফ্রি কোকা-কোলার একটা করে কুপন পাঠালেন।
ফ্রিতে পেলে কে না একবার চেখে দেখে বলুন। আর যদি চেখে দেখার পর ভালো লেগে যায় তাহলে তো কেল্লা ফতে।
হ্যাঁ, যেমনটা ভাবছেন তেমনটি ঘটেছিল ১০ বছরের কম সময়ের ব্যবধানে কোকা-কোলার বাৎসরিক বিক্রি গিয়ে দাঁড়ায় আড়াই লক্ষ গ্যালোন। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬০০ থেকে আড়াই লক্ষ গ্যালন। তফাতটা ধরতে পারছেন?
এরই মাঝে কোকা-কোলার রেসিপিতে পরিবর্তন এসেছে একাধিকবার। যে Coca Leaves দিয়ে এটি তৈরি হতো তাতে রয়েছে বড় মাত্রার কোকেইনের উপস্থিতি। যা ভয়ঙ্কর একটি মাদকদ্রব্য। একটা সময় ছিল যখন প্রতি গ্লাস কোকে ৯ মিলিগ্রাম কোকেইন থাকতো। পরবর্তীতে আমেরিকায় কোকেইন ডিস্ট্রিবিউশন নিষিদ্ধ হওয়ায় Decocainized Coca Leaves ব্যবহার শুরু হয় এবং সে প্রক্রিয়া এখনও চলমান।
"Decocainized" means the cocaine has been removed from a substance, usually coca leaves. This makes the product safe to use while keeping its original flavor.
Source: ChatGPT
যদিও ব্যবহৃত Coca Leaves শতভাগ কোকেইন মুক্ত কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এর সাথে সেই Carbonated Water, ক্যাফেইন, ফসফরিক অ্যাসিড, রঙ আর বাকিটংর পুরোটাই চিনি। সেই চিনি যেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ডাকেন White Poision।
৩৩০ মিলিলিটারের একটি কোকা-কোলা পান করলে ১০ চা চামচ পরিমাণ চিনি সরাসরি আপনার শরীরে প্রবেশ করে। যা প্রতিদিন গ্রহণযোগ্য চিনির পরিমাণের মাত্রার প্রায় আড়াই গুণ। এতটা চিনি একবারে খেলে যে কারো বমি হয়ে যেতে পারে। তবে এখানে খেলা দেখায় ফসফরিক অ্যাসিড। কোকের মিষ্টতা কমিয়ে ফেলে এটি। ফলে আরামসে ঢক ঢক করে গিলে ফেলা যায় পুরোটুকু।
আর যে ক্যাফেইন ব্যবহার হতো তার উৎস ছিল Kola Nut। কোকের আকাশ শোয়া জনপ্রিয়তা আর চাহিদার কারণে এখন আর Kola Nut চা পাতা বা কফি বিনের মতো প্রাকৃতিক উৎসে পোষায় না। এখন ভরসা আলকাতরা। আপনার হাতের কোকের বোতলটিতে যার জন্য এত মাদকতা তার জন্ম আলকাতরা থেকেই। কোক যে শরীরের জন্য খুব একটা ভালো কিছু না সেটা আমরা কম বেশি সবাই জানি। উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত পানীয় পানে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। বাড়ে রক্তচাপ। এ ধরনের চিনিযুক্ত পানীয় নিয়মিত গ্রহণে ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কোক খায় মেক্সিকোর লোকেরা। সেখানে ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যু মোটামুটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোকা-কোলা কোম্পানি কিন্তু এসব স্বীকার করতে একেবারেই নারাজ। নারাজ হবারি কথা। তদের তো দরকার মুনাফা। আর এই মুনাফার জন্য কম ছল-ছাতুরি বা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়নি কোকা-কোলা কোম্পানি।
২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় নিজের প্রশারের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায় কোকা-কোলা কোম্পানি। প্রতি বোতল কোক মাত্র ৫ সেন্টের বিনিময়ে যুদ্ধরত আমেরিকান সেনাদের কাছে বিক্রি করে তারা। উদ্দেশ্য সবার চোখে দেশ প্রেমিক হওয়া।
পরবর্তীতে এই আমেরিকান সেনাদের হাত ধরেই কোক সারা বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। আর এর মাত্রা এতটাই যে খোদ জার্মানীরা কোকা-কোলা কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠে। কিন্তু তাদের কাছে বেচলেও সমস্যা। দেশপ্রেম থাকবে না! কিন্তু ব্যবসাতো করতে হবে। তাই শেষমেষ কোকা-কোলা কোম্পানী জার্মানীদের জন্য নিয়ে আসে নতুন পানীয়। যার নাম FANTA। এতে যুদ্ধরত দুই পক্ষের কাছেই ব্যবসা করা গেল। কোম্পানীর প্রচারও হয়ে গেল। আবার দেশপ্রেমও থাকলো।
বলা হয়ে থাকে, এখন পর্যন্ত যত কোকা-কোলা উৎপাদন হয়েছে সেগুলো যদি সাড়ে ৭ ইঞ্চির দৈর্ঘ্যের বোতলে রেখে একটির উপর আরেকটি জোড়া লাগানো যায় তাহলে যে দৈর্ঘ্যটি হবে তা দিয়ে সেটা পৃথিবী থেকে চাঁদে ১৬৭৭ বারও বেশি যাওয়া আসার দূরত্বের সমান। প্রতিদিন বিশ্বে গড়ে ১.৯ বিলিয়ন বোতল কোক বিক্রি হয়। শুধু মাত্র কিউবা ও উত্তর কোরিয়া বাদে এমন কোনো দেশ নেয় যেখানে আপনি কোকা-কোলা পাবেন না।
পকেটের টাকা খরচ করে আলকাতরা মিশ্রিত ক্যাফেইন আর চিনি গুলানো পানীয় গলায় ঢেলে নিজের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়ে সে নেশার আড্ডায় আপনিও শামিল হবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।
Source
Type | Source |
Main Content | তথ্যচিত্র |
Images | Pixels, Pixabay, Wikipedia |
Other Source | Wikipedia, ChatGPT |
Report This Post
All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.