আসলেই কি আমরা মুরগি খাচ্ছি?
হঠাৎ আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শরীরে কোনো ওষুধই আর কাজ করছে না। অজানা কোনো কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে শূন্যের কোঠায়। ডাক্তার বলেছে, আপনি এত পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়েছেন যে আপনার শরীরে আর কোনো অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না। অথচ আপনার যাপিত জীবনে তেমন কোনো মেডিসিন আপনি গ্রহণ করেননি। ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুত তাই না? কারণ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান আপনি।
কিন্তু কারণটা যে লুকিয়ে আছে আপনার খাবার টেবিলে! না, আপনার খাবার টেবিল কোনো দোষ করেনি। তবে প্লেটে পড়ে থাকা সুস্বাদু চিকেনের টুকরো দিয়ে একটু একটু করে আপনার জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুনে কিছুটা অবাক লাগছে তাই না? তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
এর পিছনের কারণ জানতে আপনাকে একটুখানি দৃষ্টিপাত করতে হবে লোভনীয় এই পোল্ট্রি
আর যা কিনা দেহের অভ্যন্তরের কোষগুলোকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলে। একটি কোষ নষ্ট হলে পাশের কোষ নষ্ট হতে শুরু করে। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকেই বলা হয় ক্যান্সার। অর্থাৎ সোজাসুজি বললে ক্রোমিয়াম বিষের পরিপূরক। ২৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপ সহনীয় ক্ষমতা রয়েছে এই ক্রোমিয়ামের। যেখানে আমরা রান্না করি মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাই রান্নার মাধ্যমে মাংসে মিশে থাকা ক্রোমিয়াম দূর হওয়ার প্রসঙ্গ একেবারে যুক্তিযুক্ত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক জনাব আবুল হোসেনের একটি গবেষণায় উঠে আসে,
অংশ | পরিমান (মাইক্রোগ্রাম) |
মাংস | ৩৫০ |
হাড় | ২০০০ |
কলিজা | ৬১২ |
মগজ | ৪৫২ |
রক্ত | ৭৯০ |
অর্থাৎ নিঃসন্দেহে গোটা মুরগিটাই বিষে বিষাক্ত। এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ব্রয়লার মুরগি । মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং দ্রুত ওজন বৃদ্ধি করার জন্য খাবারের সঙ্গে মেশানো হয় ভিটামিন, ক্যালসিয়াম। আর ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পুশ করে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। যার মধ্যে রয়েছে RENAMYCIN, AZITROMYCIN, COLISTIN, CTT এর মতো বেশ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক। ফলস্বরূপ চরচর করে বড় হচ্ছে আর হু হু করে বাড়ছে মুরগির ওজন।
মুরগির মাংসের সঙ্গে এসব অ্যান্টিবায়োটিক যখন আপনার শরীরে ঢোকে তখন এর পরিণাম কী হয় জানেন?
শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আপনার শরীরে কাজ করবে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। ছোটখাটো পেটের রোগ, সর্দি, কাশি কিংবা মাথা ব্যথা ক্ষেত্রেও ওষুধ কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসবে না।
কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি! ব্রয়লার মুরগির মাংসে প্রচুর চর্বি থাকায় তা কোলেস্টেরল বাড়াতে যেন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই ব্রয়লার মুরগি খেলে কোলেস্টেরল জনিত অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ।
পুরুষত্ব হ্রাস! গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসকল পুরুষ নিয়মিত ব্রয়লার মাংস খায় তাদের জম্মদান ক্ষমতা স্বাভাবিক পুরুষের চেয়ে কম। ব্রয়লার মুরগিকে অল্প সময়ে মোটাসোটা করার জন্য সিনথেটিক হরমোন দেওয়া হয়। যা পুরুষের স্পার্ম সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে। এবং এটি মানুষের প্রজনন ক্ষমতার ব্যাঘাত ঘটায়।
আপনার খাবার টেবিলে পৌছনোর আগেই মুরগিগুলোকে একটা লম্বা পথ পার করতে হয়। তাদের যাত্রা শুরু হয় কোনো হ্যাচারি থেকে। যেখানে কৃত্রিম উপায়ে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। এরপর খাঁচার মতো দেখতে এই বাক্সবন্দি করে পাঠানো হয় অন্য কোনো ফ্যাক্টরিতে। যেখানে শুরু হয় তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ। তারা যে প্রাণী কিংবা জীবন আছে তাতে তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
জন্মের ঠিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুরুষ বাচ্চাগুলোকে আলাদা করে সেগুলোকে মেরে ফেলা হয়। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন। কেননা এই ইন্ডাস্ট্রিতে পুরুষ বাচ্চাগুলোর কোনো মূল্যই নেই। তারা ডিম দেয় না। আর মিড প্রোডাকশনের জন্য মুরগির মতো দ্রুত বড় হয় না। এতে খরচের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। এই ব্লেন্ডার মেশিনের মধ্য দিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলার কাজ করা হয়। এরপর এগুলো দিয়ে তৈরি হয় অ্যানিম্যাল ফিট। প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন বাচ্চা এভাবে মেরে ফেলা হয়।
সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা এই বাচ্চাগুলোর সাথে এমন আচরণ আপনার কাছে কতটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়? শুধু কি তাই?
অপরিপক্ক এবং তুলনামূলক ছোট বাচ্চাগুলোকে আলাদা করা হয়। কেননা ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের কোনো মূল্য নেই। আর এই বাচ্চাগুলোকেও এমন নৃশংস ভাবে মেরে ফেলা হয় অথবা জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। এরপর বেঁচে যাওয়া বাচ্চাগুলোকে ধরাও পাকরাও করে ভ্যাকসিনেশন করা হয়।
এরপর তাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল কোনো একটি মুরগির ফার্ম। তবে সেখানে পৌঁছনোর পরও মারা যায় অনেক বাচ্চা। আর বেঁচে যাওয়া বাচ্চাগুলোর জন্য অপেক্ষা করে আরো ভয়ঙ্কর কিছুর। একটি সাধারণ দেশি মুরগির বাচ্চা থেকে পরিণত মুরগিতে রূপান্তরিত হতে এখানে মাসের পর মাস লেগে যায়, সেখানে কী ভাবে শুধুমাত্র ২৫ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে একটি ব্রয়লার মুরগি ২ থেকে ৩ কেজি ওজন পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
যে পদ্ধতিতে মুরগির বাচ্চা গুলোকে বড় করা হয় ঠিক সেভাবে যদি কোনো মানব শিশুকে ট্রিট করা হয়, তবে এক মাসের মধ্যেই তার ওজন হবে ৬০০ পাউন্ড। মুরগির বাচ্চাগুলো যত দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাদের শরীরের মাসল গুলো সে অনুপাতে বৃদ্ধি পায় না। এবং অনেক সময় তাদের নিজের শরীরের ভার সইতে না পেরে তারা প্যারালাইসড হয়ে যায় কিংবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আর অসুস্থ কিংবা অন্য কোনো সমস্যাজনিত মুরগিগুলো অধিকাংশ স্থান পায় ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায়।
তবে এসব মৃত মুরগিগুলো যে সবসময় ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয় এমনটা কিন্তু নয়। বিভিন্ন হোটেলগুলিতে মরা মুরগি খাওয়ানো কিংবা এই জাতীয় ঘটনা আমাদের দেশে বিরল নয়। World Health Organization(WHO) এর একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিষাক্ত এসব মুরগি খাওয়ার ফলে শুধুমাত্র UK তে প্রতি দশ জনের একজন মানুষ CAMPYLOBACTER নামক এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর প্রতি বছর প্রায় ৩৩ মিলিয়ন সুস্থ শরীর অসুস্থ করে তুলে।
মুরগির খাবার তৈরির জন্য আছে নির্ধারিত কিছু নিয়ম। কিন্তু চোরেরা না শুনে ধর্মের কথা। যত দ্রুত মুরগির ওজন বৃদ্ধি পাবে তত বেশি মুনাফা লাভ হবে। প্রথম আলোর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, শুরুর দিকে পোল্ট্রি শিল্পের উন্নায়ন ছিল ৫-১০%। ২০০৭-২০১৭ এই দশ বছরে পোল্ট্রি শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫% এর বেশী। অর্থাৎ বোঝায় যাচ্ছে এই ইন্ডাস্ট্রি কত দ্রুত বাড়ছে। আর সাথে মানুষের মৃত্যু ঝুকিও।
গ্রামে এবং শহরের আনাচে-কানাচে এমন অগনিত ব্রয়লার ফার্ম রয়েছে কিন্তু নেয় কোনো স্বাস্থ্যকর কোনো পরিবেশ। খামারীরা নিজেদের লাভের জন্য মুখিয়ে থাকে। তাই আশে পাশে কি ঘটছে সেদিকে তোয়াক্কা না করলেও চলে। পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রির এই ভয়ংকর চেহারা কখনোই আমাদের সামনে আসে না। আর আসবেই কি করে?
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নিম্ম আয়ের যাতা কলে পিষ্ট হয়ে আমরা প্রতি নিয়তো হন্নে হয়ে চলছি সস্তা এবং সহজলভ্য পন্যের দিকে। কিন্তু তা আমদের উপকার করছে নাকি ক্ষতি করছে তা নিয়ে দু দন্ড ভাববার সময়টা কই?
Report This Post
All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.