আবারও কি বিশ্ব গ্রেট ডিপ্রেশনের কবলে পড়তে যাচ্ছে?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ এর টাইম ফ্রেমে দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশনের একটা ভয়াবহ শক ছিল। সেই শক ক্রমশ ডালপালা বিস্তার করে বিভিন্ন ভাবে স্পর্শ করেছিল সমাজের নানা স্তরের সব মানুষকে। আমেরিকার ব্যাংক সিস্টেম কোল্যাপস হয়েছিল। এক তৃতীয়াংশ ব্যাংক মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বেকারত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৫%। গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছিল বেড়েছিল সুইসাইডের হারও।
"নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না" - এই সূত্র মেনে বিশ্ববাজারেও ক্রমশ পড়েছিল এই গ্রেট ডিপ্রেশন এর ছাপ। রাজনীতির সমীকরণে এসেছিল এক বিশাল পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছিল মানুষের জীবনযাপনেও। আর এরমধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে ডিপ্রেশনের পালাবদলকে করেছিল আরও একটু গভীর। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা সেই ভয়াবহ গ্রেট ডিপ্রেশন গত হয়েছে। কিন্তু গত হলেও পুরোপুরি কিন্তু অদৃশ্য হয়নি এই গ্রেট ডিপ্রেশন এর প্রত্যাবর্তনের সম্ভব। বরং ক্ষণে ক্ষণেই সেই দিচ্ছে ফেরার পূর্বাভাস। যেটা অ্যালার্মিং। করোনা ভাইরাসের বিপুল ব্যবসায়িক মন্দা হোক কিংবা খুব জিওপলিটিক্স এর পালাবদল থাকুক, নানা সমীকরণের কুটচালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কিংবা বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের আভাস। সাম্প্রতিক বিশ্বের নানাবিধ অনুঘটক মিলে মিশে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে আরেকটি গ্রেট ডিপ্রেশন বোধহয় আসছে খুব তাড়াতাড়ি।
প্রথমেই বলি বেকারত্ব নিয়ে। অনেকে যদিও বলেন, ১৯২৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকার স্টক বাজারে দর পতনের পরে মূলত বিশ্বব্যাপী গ্রেট ডিপ্রেশন শুরু হয়। কিন্তু এই দরপতনই বিশ্বমন্দার মূল কারণ নয়। বরং ১৯২০ সালের এপিডেমিক SPANISH FLU এর পরে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবন নিত্য প্রয়োজনীয় নানা সেবার মান ক্রমশ পড়ে যাওয়া এবং সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা সব কারণে প্রভাব রেখেছিল দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশন এর পেছনে। এ ডিপ্রেশনের কারণে ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রায় ১৫% হ্রাস পায়। আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অস্থিরতা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে যায় ৫০%। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বেড়ে যায় ২৫%। কিছু দেশে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩% পর্যন্ত। এবং আশ্চর্যের বিষয় এটাই গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ের যে বেকারত্বের পরিস্থিতি এমনটা আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের সময়েও।
World Economic Forum এ সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ৭৫ মিলিয়ন চাকরি বাদ হয়ে যাবে। দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো, কারিগরি জ্ঞানের অভাব, মূলধনের অভাব, অনুন্নত বিশ্বের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, জাতীয় উৎপাদন ও আয় হ্রাস, মাদকাসক্তির হার বৃদ্ধি, ইত্যাদির কারণে বাড়ছে বেকারত্ব। এছাড়াও তা হতে পারে সবচেয়ে বেশি অটোমেশনের কারণে বা এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর কারণে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সও বলছে,
বিশ্বব্যাপী তিনশ মিলিয়ন ফুল টাইম জব চলে যাবে প্রযুক্তি হাতে।
২০১২ সালের পরবর্তী সময় থেকে গুগল কমিয়েছে ৬৫% সেলস রিলেটেড জব। যে কাজগুলো এখন করছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানগুলোর শতকরা ৯০% ইতিমধ্যেই এআই টেকনলজি তে ইনভেস্ট করা শুরু করেছে। যার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ নিয়মিত হারাচ্ছে তাদের চাকরি। ফলাফল বাড়ছে ডিপ্রেশন।
দ্বিতীয়ত রোগ ব্যাধির বিস্তার। ১৯১৮ সালের শেষের দিকে ভয়ঙ্কর এক মহামারী সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। মহামারীর নাম ছিল SPANISH FLU। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই Flu তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৫ কোটিরও বেশি মানুষের। এই সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার চাইতেও অনেক বেশি। সে সময় ক্যান্সার, Respiratory diseases, এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগগুলো বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। প্রতি ১০ জন আমেরিকানের মধ্যে একজন আক্রান্ত হয়েছিল সিফিলিস রোগে। এছাড়াও অন্যতম ভয়ঙ্কর ছিল পোলিও রোগ। গ্রেট ডিপ্রেশনের এই সময়কালে পোলিও ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্যুৎ গতিতে। এমনকি তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট Franklin D. Roosevelt ও আক্রান্ত হয়েছিলেন এই পোলিও রোগে।
যদি সাম্প্রতিক পৃথিবীতে তাকাই দেখব সেখানেও আশ্চর্য এক মিল। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মহামারি করোনাতে লিন হল সারা বিশ্ব। World Health Organization মতে,
করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে মৃত্যু স্পর্শ করল তিন মিলিয়ন মানুষকে। TOTAL GLOBAL WORKING HOUR এর ৮.৮% নষ্ট হল। ২৫৫ মিলিয়ন মানুষ হারাল তাদের চাকরি।
বলাই বাহুল্য মহামারীর কারণে হওয়া ক্ষত কিংবা ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেউই। World Health Organization এর গাইডলাইন অনুযায়ী ডিপ্রেশন কে যেকটি বিষয়ে দ্বারা চিহ্নিত করা হয় সেগুলো হল দুঃখ, আগ্রহ বা আনন্দ হারিয়ে ফেলা, অপরাধ বোধ, নিজেকে মূল্যহীন লাগা, ঘুম ও ক্ষুধায় বিরক্তি, দুর্বল মনোযোগ। সারাক্ষণ দ্বিধায় থাকছে মানুষ। কী করবে এটা ভেবে বের করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
তৃতীয়ত, পারস্পরিক সম্পর্ক জনিত দূরত্ব। গ্রেট ডিপ্রেশনের কারণে যেহেতু বেকারত্ব বেড়েছিল তুমুলভাবে সেহেতু সম্পর্কগুলো ক্রমশ হচ্ছিল শিথিল। পরিবারের চাহিদা পূরণ না করতে পেরে অনেকেই সুইসাইড করেছিলেন। যদি বর্তমান সময়ে তাকাই দেখব সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখা যাচ্ছে এখনও। প্রেম ভালোবাসা কিংবা কাছের মানুষের দেখা পাওয়া এই বিষয়গুলোকেও যে কমার্শিয়ালাইজ করা যায় সেটাই খুব রূঢ়ভাবে উঠে এসেছে tinder, bumble এর টেমপ্লেটে। বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। সম্পর্ক গড়ছে না বরং দিন দিন কেবল ভাঙছে। বাড়ছে সন্দেহ, বাড়ছে ডিপ্রেশন এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটের সহজলভ্যতা। অ্যাড্রিনালিন হ্রাস হচ্ছে মুহুর্তে। ফলাফল একটা সময় মনে হয় আর কিছুই পাবার নেই আমার।
মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। আর এই হতাশা থেকেই বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। দ্যা গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েনও বেশ আলোড়ন ফেলেছিল। অর্থনৈতিক ডামাডোলে জার্মানিতে হিটলার এবং জাপানে জ্যাপ আর্মির শাসন ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়েছিল। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সামনে প্রকট হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বর্তমানে পৃথিবীতে তাকালেও দেখব সে রকমই একটা প্রসঙ্গ। যেখানে প্রধান কুশীলব রাশিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়া বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ইরান বনাম ইসরায়েল, ইরান বনাম পশ্চিমারাষ্ট্র - নানা ভাগে ভাগ হয়েছে এই যুদ্ধের বাজনা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে এর সাথে। একা হাতে সংসার চালাতে মানুষ হিমসিম খাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করছে,
২০৩০ সালের মধ্যে বিষণ্ণতা হবে বিশ্বের একমাত্র প্রধান রূপ।
সব কিছুর পাশাপাশি তুলনার পারস্পরিক বিশ্লেষণে এটা স্বীকার করতেই হয়, গোটা বিশ্ব এক টালমাটাল সময় পার করছে এখন। যদি এমনটাই চলতে থাকে নিয়মিত এবং এভাবেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাহলে খুব তাড়াতাড়িই কি আরেকটি গ্রেট ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হবে? মানুষ প্রশ্নটা থেকেই চাই।
Report This Post
All sources, including information, images, and videos, for our posts are listed here . If there are any copyright claims, please report this post or contact us or mail at info@beeblogquester.com.