আপনার ডোপামিন নিয়ন্ত্রন করুন!
ডোপামিন, The Neurotransmitter of Brain। ডোপামিন একটা Feel Good Hormone। মানব মস্তিষ্ক ও শরীরে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এই হরমোন। কিন্তু প্রযুক্তি বিশ্বে গত কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে ডোপামিন ফাস্টিং অর্থাৎ ডোপামিন উপবাস। আস্তে আস্তে এই ট্রেন সিলিকন ভ্যালি থেকে ছড়িয়ে যায় উন্নত বিশ্বের অনেক স্থানে। কারণ হিসাবে তারা বলছে, ডোপামিন একটি মোটিভেটিং ব্রেন কেমিক্যাল।
কোন একটা কাজের জন্য মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন তখনই ক্ষরিত হয়, যখন কেউ অনুভব করে যে কাজটা করলে সে আনন্দও পাবে। একে বলা হয় রিওয়ার্ড মোটিভেশন এফেক্ট। বিষয়টাকে এমনভাবে বলা যেতে পারে যে, অণুপ্রেরণার নামে ডোপামিন মানুষের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে বহু ক্ষেত্রে।
ডোপামিন ফাস্টিং কেন ট্রেন্ডিং এ আছে? আসছি সে কথায় একটু পরে। কিছুদিন আগে VOICE OF DHAKA কমিউনিটিতে একটা পোস্ট করা হয়েছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করার সময় মনোযোগ বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি কীসে? ম্যাক্সিমাম উত্তর এসেছে ইলেকট্রনিক গ্যাজেটসের নোটিফিকেশন।
অর্থাৎ প্রযুক্তি অগ্রসরতায় মানুষ হারাচ্ছে তার সফলতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ফোকাস। ধুম করে একটা শব্দ! নোটিফিকেশন, মেসেজ একবার বারবার! স্টাডি বলে, কোনও কিছুতে ফোকাস আনতে ২৩ মিনিট সময় দরকার। থেকে থেকেই স্মার্টফোনের ছোট্ট একটা টুম বা ল্যাপটপের সশব্দ রিমাইন্ডার, মনোযোগ কেন্দ্রচ্যুত হতে থাকে ক্রমশ। যখন একটা নোটিফিকেশন কিংবা কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ নক করে আমরা তখন একটা সেন্স অব ভ্যালিডেশন পাই। ছুটে যায় সেদিকে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমরা নিজেই জানি, যা করছি তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। এদিকে আমাদের হারানো ফোকাস আবার পুনরুদ্ধার করতে সেই ২৩ মিনিট সময় লাগবে। সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক, কমেন্ট, তুমুল ডোপামিনের ক্ষরণ আমাদের মনোযোগের সীমাকে ক্রমশ কমিয়ে ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু করে তুলছে। একটা অদ্ভুত সন্তুষ্টিতে কিংবা মোহে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি এক খাদের দিকে। যে খাদ এর নাম Over Stimulation। বাংলায় অতি উদ্দীপনা।
এই 21 Century তে পৃথিবী কিন্তু তার গতি বাড়ায় নি এক বিন্দুও। অথচ আমাদের অর্থাৎ মানুষের গতি ভয়াবহ বেড়ে গেছে। আমরা এমন এক দুনিয়া দেখছি যেখানে শর্ট ফর্ম কনটেন্ট রাজত্ব করছে। যেখানে ১৫ সেকেন্ডের টিকটক বা রিলস বেশি ডোপামিন ক্ষরণ করছে সেখানে কী দরকার এত সময় নষ্ট করার। এই প্রসঙ্গে পিছিয়ে যায় কয়েকশো বছর আগেকার সময়। আমাদের পূর্বপুরুষরা শিকারের নামতো। বহু অপেক্ষার পর কোনো বন্যপ্রাণী দেখলে তাদের ব্রেন থেকে ডোপামিন হ্রাস হতো।
তারা ভাবতো এই প্রাণীকে মারতে পারলে তাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা হবে। একটা প্রবল আনন্দের ব্যাপার। অর্থাৎ ডোপামিন তাদেরকে গাইড করত। গাইড করত পরিশ্রমের কাজে। যে কাজে দরকার একাগ্র ফোকাস। অথচ আমাদের মস্তিষ্ক পাল্টায়নি গত হাজার বছরেও। অর্থাৎ আমাদের ব্রেনের মেকানিজম আমাদের পূর্বপুরুষদের মতোই আছে। সেক্ষেত্রে কঠিন কোনও কাজে সফল হলেই Over Stimulation কিংবা ডোপামিন ট্রিগার হওয়ার কথা। কিন্তু তার না হয়ে আমাদের Over Stimulation এখন হচ্ছে সহজে, সস্তা কাজে।
কিন্তু কেন?
কারণ একটি Social Paradox। বস্তুবাদী বলা হোক কিংবা বলা হোক টেকনোলজির অতি বাড়াবাড়ি। দ্রুত বদলাচ্ছে চারপাশ। Over Stimulation এখন অনায়াসে অল্প পরিশ্রমে কিংবা কখনও কখনও পরিশ্রম ছাড়াই পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের এখনকার পৃথিবীতে যেন Supernormal Stimulus এর ছড়াছড়ি। Supernormal Stimulus বিষয়টাই এমন - একটা ন্যাচারাল বিষয়কে বাইপাস করে সেখানে আর্টিফিশিয়াল অন্য কিছুকে নিয়ে আসে। যেমন আপেল খাওয়া শরীরের জন্য ভালো এটা নরমাল Stimulus। কিন্তু Supernormal Stimulus যা করবে সে আপেলের বদলে প্রিজারভেটিভ মেশানো চটকদার আপেল জুস এনে অল্টারনেটিভ তৈরি করবে। কারণ এখনকার পৃথিবীতে সব কিছু ডিজাইন করা মানুষের সুখের কথা চিন্তা করে।
খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের চারপাশের আধুনিক প্রযুক্তিগুলিও এমন ভাবে ডিজাইন করা যাতে ভাবনার চেয়ে ভাবনাহীন কাজগুলোতে Over Stimulation তাড়াতাড়ি করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কথাই ধরুন না! ফেসবুকে আপনার কোনও পোস্টে বেশ ভালো ভালো কিছু লাইক, কমেন্ট এলে আপনার মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন ক্ষরণ হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট না পেলে FoMO জেকে বসছে। তারা Human Brain কে ম্যানিপুলেট করে, ডোপামিন লেভেল কন্ট্রোল করে, অ্যালগরিদম মার্কেটিং আর অন্য সব ট্যাকটিক্স এর মাধ্যমে। এই লুপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আপনি হারাচ্ছেন ফোকাস, আরও বেশি হতাশ হচ্ছেন।
আশার ব্যাপার বর্তমানে এই, ডোপামিনের লুপ থেকে বেরোতে চাইছে অনেকে। এজন্যে যে জনপ্রিয় ট্রেন্ড ডোপামিন ডিটক্স। তার কথায়, একটু আগেই বললাম। যে ডোপামিন ডিটক্স সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে বলে সেই ডোপামিন ডিটক্স আবার ভাইরাল হয়েছে ওই সোশ্যাল মিডিয়াতে। শুধুমাত্র টিকটক এই ডোপামিন ডিটক্স হ্যাশট্যাগ ২০ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে। ডোপামিন ডিটক্স বলে যত বেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায় তত কম ডোপামিনের ক্ষরণ করা সম্ভব।
প্রশ্নটা কিন্তু সেখানে, প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা ঠিক কতটুকু কমানো সম্ভব? অবধারিতভাবে পরের প্রশ্ন তাহলে কী করা যেতে পারে?
যা করতে হবে তাহলো Alive থাকা, Flow State এ থাকা। Flow State মানে হচ্ছে মন ও শরীরের মধ্যে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ। আমরা যখন এটা করতে পারব, আমরা আমাদের কাজে আরও সজাগ হব এবং সবচেয়ে বেশি ফোকাসড হবো। কিন্তু Flow State এর সবচেয়ে বড় সমস্যা। এটা কিন্তু সব সময় পাওয়া যায় না। এই Flow State এর জন্য অনেক সময় বেরিয়ে যেতে হয় কমফোর্ট জোন থেকে। তবু Flow State এ আসা কিংবা Healty Life Style প্র্যাক্টিস করা এই সময়ে এসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে মন ফুরফুরে রাখা, ম্যানিপুলেটেড টুল ব্যবহার করে যখনই কন্ট্রোল করতে আসবে কেউ সচেতন হয়ে সেটিকে প্রতিহত করা নিজের দায়িত্ব। তাহলে কিন্তু ফোকাসটা বাড়বে। কারণ দিনশেষে সত্যি তো এটাই --